ডেস্ক:
ধারাভাষ্যকার চিৎকার করে বলছেন, “ক্যান ইউ বিলিভ ইট…!” বোলার নিল ওয়্যাগনার তখন খ্যাপাটে দৌড়ে ছুটে চলেছেন দুহাত ছড়িয়ে। একটু পর তিনি হারিয়ে গেলেন সতীর্থদের আলিঙ্গনের বৃত্তে। লেগ স্টাম্পের বাইরে ডাইভ দিয়ে ক্যাচ নিয়ে টম ব্লান্ডেল উদযাপন করছেন মাটিতে শুয়েই। ধারাভাষ্যকক্ষে ইংলিশ গ্রেট ডেভিড গাওয়ারের উচ্চারণ, “এখনই কি সময় ‘বেয়ারেস্ট অব মার্জিনস’ কথাটি আবার ফিরিয়ে আনার…!”
ব্যবধান যখন স্রেফ ১ রানের, বিখ্যাত লাইনটি ফিরিয়ে আনাই যায়। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষ মুহূর্তে লর্ডসের ধারাভাষ্যকক্ষে ইয়ান স্মিথের বলা যে কথাটি পরে জায়গা পেয়ে গেছে ক্রিকেটের চিরন্তন লোকগাঁথায়। ওই ফাইনালের যে রোমাঞ্চ, উত্তেজনা আর রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তি, সেটির তুলনীয় আর কিছু হবে না বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু ক্রিকেট আরও একবার দেখিয়ে দিল, তার ভাণ্ডারে শেষ বলে কিছু নেই।ওই ফাইনালের দুই দলই উপহার দিল অবিস্মরণীয় আরেকটি ধ্রুপদি লড়াই। এবার শ্বেতশুভ্র পোশাকে, ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণে। অবিশ্বাস্য নাটকীয়তার নানা মোড় পেরিয়ে ওয়েলিংটন টেস্টে ইংল্যান্ডকে ১ রানে হারাল নিউ জিল্যান্ড।সেই নিউ জিল্যান্ড, টেস্টের তৃতীয় দিনে যারা ফলো-অনে পড়েছিল। সেই নিউ জিল্যান্ড, শেষ দিনের আগ পর্যন্ত যারা ছিল হারের মুখে। ঘুরে দাঁড়ানোর বিরল নজির গড়ে তারাই শেষ পর্যন্ত হারিয়ে দিল ব্রেন্ডন ম্যাককালাম-বেন স্টোকসের আগ্রাসী ও অপ্রতিরোধ্য ইংল্যান্ড দলকে।১৪৬ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ১ রানের জয়ের মাত্র দ্বিতীয় কীর্তি এটি। ফলো-অনে পড়ার পর টেস্ট জয়ের ঘটনা আগে ছিল স্রেফ তিনটি। ম্যাককলাম-স্টোকস জমানায় ১২ টেস্টে স্রেফ দ্বিতীয়বার হারল ইংল্যান্ড। ঘরের মাঠে কিউইদের অপরাজেয় যাত্রা পৌঁছে গেল টানা ১২ সিরিজে।তবে এসব এসব রেকর্ড-পরিসংখ্যানও আসলে বোঝাতে পারবে না, কতটা উত্তেজনাময় ছিল এই ম্যাচ আর শেষের সময়টুকু।২৫৮ রান তাড়ায় ৮০ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড যখন পথহারা, তখন স্টোকস আর জো রুটের জুটি তাদেরকে এগিয়ে নেয় জয়ের পথে। কিন্তু আেই জুটি ভেঙে দ্রুত তিন উইকেট নিয়ে আবার ম্যাচের লাগাম নেয় নিউ জিল্যান্ড। বেন ফোকসের ব্যাটে ইংল্যান্ডও লড়ে যেতে থাকে। এরপর শেষ জুটির রোমাঞ্চ। টিম সাউদির বলে জিমি অ্যান্ডারসনের বাউন্ডারিতে জয় চলে আসে ইংল্যান্ডের নাগালে। কিন্তু শেষ হাসি কিউইদের। ওয়্যাগনারের লেগ স্টাম্পের বাইরের বলে অ্যান্ডারসনের ফ্লিক করার চেষ্টায় বল লাগে ব্যাটের কানায়, উইকেটের পেছনে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ক্যাচ নিয়ে কিউইদের আনন্দে ভাসান কিপার ব্লান্ডেল।
নিউ জিল্যান্ড এক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনে ওয়্যাগনার ও তার শর্ট বলের কৌশলকে। চেনা সেই কৌশল কাজে লেগে যায় দারুণভাবে। স্টোকসকে (১১৬ বলে ৩৩) বিদায় করে তিনি ভাঙেন ১২১ রানের জুটি। এরপর শর্ট বলেই তিনি থামিয়ে দেন সেঞ্চুরির দুয়ারে থাকা রুটকেও।প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করা রুট এবার বিদায় নেন ৮ চার ও ৩ ছক্কায় ১১৩ বলে ৯৫ রান করে।
একটু পর ম্যাট হেনরি যখন আউট করে দেন স্টুয়ার্ট ব্রডকে, ম্যাচ তখন আবার নিউ জিল্যান্ডের প্রায় মুঠোয়। ইংলিশদের রান ৮ উইকেটে ২১৫।
কিন্তু এই ম্যাচের উত্তেজনা কী আর এতটা সহজে শেষ হয়!কিপার-ব্যাটসম্যান বেন ফোকস লড়াই চালিয়ে যান নবম উইকেটে জ্যাক লিচকে সঙ্গে নিয়ে। একটু একটু করে ইংল্যান্ড আবার এগিয়ে যেতে থাকে জয়ের দিকে। এই জুটিতে দলের রান পেরিয়ে যায় আড়াইশ।এরপর শেষের নাটকীয়তা। জয় যখন কেবল ৭ রান দূরে, কিউই অধিনায়ক টিম সাউদির বাউন্সারে পুল করে ফোকস আউট হয়ে যান ৩৫ রানে। সীমানায় ঠাণ্ডা মাথায় বল মুঠোয় জমান ওয়্যাগনার।পরের ওভারে ওয়্যাগনারের বলেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে বল যখন বাউন্ডারিতে পাঠান শেষ ব্যাটসম্যান অ্যান্ডারসন, ম্যাচ ‘টাই’ করতে তখন প্রয়োজন স্রেফ ১ রানের।পরের ওভারটি সাউদি করেন মেইডেন। এরপর ওয়্যাগনারের ফেরা এবং ওভারের দ্বিতীয় বলেই ম্যাচের সমাপ্তি। কিউইদের বাঁধনহারা উল্লাসের মঞ্চে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অ্যান্ডারসন। তিনি যে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না।একটু পর দেখা গেল গেল স্টোকসকে। ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে ইংল্যান্ড অধিনায়ক হাত মেলাচ্ছেন নানা জযের মুখে। কিন্তু এমন পরাজয়ের পরও তার মুখে হাসি!তবে সেই হাসিটুকুও হয়তো মানিয়ে গেল। জয়-পরাজয় ছাপিয়ে ক্রিকেটের চিরন্তন অনিশ্চয়তা আর বিশালত্বই ফুটে উঠল যেন ইংলিশ অধিনায়কের ওই হাসিতে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ইংল্যান্ড ১ম ইনিংস: ৮৭.১ ওভারে ৪৩৫/৮ (ডি.)
নিউ জিল্যান্ড ১ম ইনিংস: ২০৯
নিউ জিল্যান্ড ২য় ইনিংস (ফলো-অনের পর): ৪৮৩
ইংল্যান্ড ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ২৫৮, আগের দিন ৪৮/১) ৭৪.২ ওভারে ২৫৬ ( ডাকেট ৩৩, রবিনসন ২, পোপ ১৪, রুট ৯৫, ব্রুক ০, স্টোকস ৩৩, ফোকস ৩৫, ব্রড ১১ , লিচ ১*, অ্যান্ডারসন ৪; সাউদি ২০.১-৫-৪৫-৩, হেনরি ২১.৫-৩-৭৫-২, ব্রেসওয়েল ১৭-২-৭৩-০, ওয়্যাগনার ১৫.২-০-৬২-৪)।
ফল: নিউ জিল্যান্ড ১ রানে জয়ী।
সিরিজ: ২ ম্যাচ সিরিজ ১-১ ড্র।
ম্যান অব দা ম্যাচ: কেন উইলিয়ামসন।
ম্যান অব দা সিরিজ: হ্যারি ব্রুক।
You cannot copy content of this page