নিজস্ব প্রতিবেদক
হঠাৎ করেই গত কয়েক বছর আগে দেশের বিভিন্ন নদী, পুকুর, জলাশয়ের পানিতে অস্তিত্ব জানান দেয় অ্যাকুরিয়ামের শোভা বর্ধক ও আবর্জনাভূক ‘সাকার মাছ’। শুরুতে এটি তেমন আমলে না নিলেও দিন বাড়ার সাথে সাথে হয়ে উঠেছে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন নদ-নদী, পুকুর এমনকি জলাশয়ও এখন এ রাক্ষুসে মাছে ছয়লাপ।
শনিবার (২৬ আগস্ট) সকালে রাজধানীর ঢাকা কলেজের পুকুরেও মিলল রাক্ষুসে নিষিদ্ধ এ ‘সাকার মাছ’। অবস্থা এমন শোচনীয় যে জাল একবার টান দিতেই মিলেছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক ‘সাকার’। এ যেন পুরো পুকুরজুড়েই একক রাজত্ব গড়ে তুলেছে এ জাতের মাছ। শুধু বড়-ছোট সাকারই নয় বরং মিলেছে সাকারের পোনাও। বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলেছে কলেজ প্রশাসনকে।
ঢাকা কলেজের শিক্ষক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ এবং উত্তর ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক ওবায়দুল করিম বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই ঢাকা কলেজের আবাসিক ছাত্রাবাস সংলগ্ন পুকুরে বড়-ছোট মৃত মাছ ভেসে উঠতে দেখা গেছে। শুক্রবার শিক্ষার্থীরা জুমার নামাজের পর অধ্যক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষকদের বিষয়টি অবহিত করেন এবং প্রতিকারের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের অনুরোধ আমলে নিয়ে পুকুরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে তাৎক্ষণিকভাবে শনিবার সকালে পুকুরে জাল টানার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ। সেই নির্দেশনা মোতাবেক সকালে জাল টানা হয়। কিন্তু অন্যান্য মাছের তুলনায় মনে হয়েছে ‘সাকার মাছ’-এর পরিমাণই বেশি। রাক্ষুসে এ মাছের এমন উপস্থিতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
তিনি আরও বলেন, এক জালেই প্রায় অর্ধশতাধিক ‘সাকার মাছ’ উঠেছে। এগুলো আলাদা করে রাখা হয়েছে। যা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হবে।
ওবায়দুল করিম বলেন, আমরা এমন পরিস্থিতি দেখে আবারও জাল টান দেই। মনে হচ্ছে এ মাছগুলো আমাদের পুকুরের স্বাভাবিক মাছের বৃদ্ধিসহ পোনা জাতীয় মাছের বেড়ে ওঠা বন্ধ করে দিয়েছে। গত কয়েক দিন আগেও (১৬ আগস্ট) আমরা পোনা ছেড়েছি। সবমিলিয়ে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। কোনোক্রমেই যেন পুকুরে বিদেশি এ মাছ বংশ বৃদ্ধি করতে না পারে, সেটি কলেজ প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরদিকে, ‘সাকার’ দেশীয় প্রজাতির মাছের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ বলে জানান ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাহসিনা জেরিন। তিনি বলেন, ‘সাকার’ বিদেশি মাছ। ধারণা করা হয়, অনুমোদন না নিয়েই আশির দশকে অ্যাকুরিয়ামে শোভা বর্ধক হিসেবে এ জাতের মাছ দেশে আনা হয়েছিল। সেখান থেকেই বিভিন্নভাবে দেশের নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে এগুলো। এর ইংরেজি নাম ‘সাকার মাউথ ক্যাটফিশ’। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইপসতোমুস প্লেকসতোমুস’। এটি দেশিয় প্রজাতির মাছের জন্য বড় ধরণের হুমকিস্বরূপ। এরা দেশিয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছের ডিম ও পোনা খেয়ে ফেলে। জলজ পরিবেশের খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট করে এরা। এর পাখা শক্ত এবং ধারালো হয়ে থাকে। ফলে, অন্য মাছের শরীরে সহজেই ক্ষত তৈরি করতে পারে এরা।
দ্রুত এবং কঠোর ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা দেশের নদ-নদী, হ্রদ, খালবিল এমনকি বদ্ধ পুকুর থেকে ‘সাকার’ নিধন করার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, দেশে যেভাবে ‘সাকার’-এর অস্তিত্ব বাড়ছে, যা খুবই আশঙ্কাজনক। সরকার ইতোমধ্যেই এ মাছ নিষিদ্ধ করেছে। তাই ‘সাকার’-এর প্রজনন ঠেকাতে ব্যক্তি উদ্যোগকেও গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে শুধু এ ‘সাকার মাছ’ই একসময় জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্টের পাশাপাশি দেশিয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠবে।
অবশ্য ইতোমধ্যেই দেশে রাক্ষুসে ‘সাকার মাছ’ আমদানি, ক্রয়-বিক্রয়, চাষ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগে, ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ‘সাকার’ নিষিদ্ধ করতে প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট ১৯৫০-এর ১৮ নম্বর ধারা সংশোধন প্রস্তাব প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করে মন্ত্রণালয়।
পরে ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি এ জাতের মাছ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আইনের ১৮ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারায় বলা হয়- ‘সাকার মাছ’ কোনো ব্যক্তি আমদানি, প্রজনন, চাষ, পরিবহন, বিক্রি, গ্রহণ বা প্রদান, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ প্রকাশ অধিকারী হতে পারবেন না।