• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪২ অপরাহ্ন

প্রতিকার চেয়ে রাষ্ট্রপতির দুয়ারে জগন্নাথ শিক্ষার্থী মিম

অনলাইন ভার্সন
অনলাইন ভার্সন
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০২৪

দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন ও পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের শরণাপন্ন হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ছাত্রী কাজী ফারজানা মিম। গত মঙ্গলবার বঙ্গভবনে জমা দেওয়া এক লিখিত আবেদনে ‘বুলিং ও যৌন নিপীড়নের দৃষ্টান্তমূলক বিচার’ চেয়েছেন এই শিক্ষার্থী। সেই সঙ্গে তার জীবনটাকে ‘পুনরুদ্ধার করার’ আকুল আর্জি জানিয়েছেন। ওই আবেদনের বিষয়ে বঙ্গভবন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে আবেদনটির ‘রিসিভড কপি’ হাতে নিয়ে বঙ্গভবনের সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুলেছেন মিম। সেখানে বঙ্গভবন নিরাপত্তা বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের সিল ও স্বাক্ষর দেখা যায়।

বঙ্গভবন নিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার শচীন ভৌমিক বলেন, “এ সংক্রান্ত একটি আবেদন গ্রহণ করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।” আবেদনে বলা হয়েছে, “আমি আপনার সুনামধন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের ৩য় ব্যাচের একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী। ২০২১ সাথের (সালের) ডিসেম্বর মাসে উপাচার্য মহোদয় বরাবর আমার সাথে ঘটে যাওয়া বুলিং ও যৌন নির্যাতনের বিচার চেয়ে একটি আবেদন দায়ের করি। বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় আমার যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলের দায়িত্বে ছিলেন। এটার বিচার আমি এখনো পাইনি, উল্টো আমাকে যৌন নিপীড়নকারী শিক্ষক এবং তার সমর্থনে বিভাগের চেয়ারম্যান, অনার্স পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে ফেইল করিয়েছেন।

অভিযুক্ত শিক্ষকেরা আমাকে ভীষণরকম বহিষ্কার ভয়ভীতি, পরীক্ষার ফেইল করানো, অনান্য শিক্ষার্থীদের থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে মানসিকভাবে নির্যাতন করে, মৃত্যুহুমকি দিয়েই যাচ্ছে, আমাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে আমি নিউজ মিডিয়াতে বিষয়টি প্রকাশ করি। “এমতাবস্থায়, মহামান্য আপনার কাছে সর্বশেষ আশা ভরসা নিয়ে আবেদন জানাচ্ছি। আপনার পক্ষ থেকে আমার এই বুলিং ও যৌন নিপীড়নের দৃষ্টান্তমূলক বিচার এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতার ব্যবস্থার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছি এবং আমাকে ফেইল করানো বিষয়গুলো আপনার নির্ধারিত বিশেষ কমিটির মাধ্যমে পূনঃবিবেচনা পূর্বক আমার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে আমার জীবনটাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য আকুল আর্জি জানাচ্ছি।” এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, মিম তার ওই আবেদনের অনুলিপি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেননি। “সে হল থেকে বের হওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু তার কোনো সাড়া পাইনি। তাকে ফোন দিলে ফোন বন্ধ পাই, আবার অনেক সময় ফোন ঢুকলেও সে ধরে না।” এক শিক্ষক ও সহপাঠীকে দায়ী করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যেই যৌন নিপীড়ন ও বুলিংয়ের এই অভিযোগ সামনে এনেছেন মিম। দুদিন আগে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের দপ্তরে গিয়েও দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে এসেছেন। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, “ওই ছাত্রীর যে সমস্যা, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাধ্যমেই সমাধান করা হবে। আমরা ভুক্তভোগী ছাত্রীর যৌন হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করছি। তাকে বারবার কেন ফেল করানো হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত করে বের করবে।”

কী অভিযোগ মিমের
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিম যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছেন তার কোর্স শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে। আর বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ আহমদ হালিমের বিরুদ্ধে এই শিক্ষার্থীর অভিযোগ, তাকে ফেল করিয়ে দিয়েছেন ওই শিক্ষক। মিম বলেন, প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন ২০২১ সালে অ্যাকাডেমিক কাজে তাকে নিজের কক্ষে ডাকেন এবং সে সময় ‘যৌন হয়রানি’ করেন। “সেদিন তিনি আমাকে কুপ্রস্তাব দেন। কুপ্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না। প্রস্তাব দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন। আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে চান। আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে তাৎক্ষণিকভাবে এই আচরণের প্রতিবাদ করি।” এই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, ওই ঘটনা নিয়ে তিনি যখন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন, তখন থেকে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা শুরু হয়। “অভিযোগ দেওয়ার পর থেকে বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমেদ হালিম ও শিক্ষক আবু সাহেদ ইমন আমাকে সেটি তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। এতে আমি রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে হাত-পা কেটে হত্যা করাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেন। আমাকে একঘরে করে দেওয়া হয়। আমাকে বিভিন্ন পরীক্ষায় শূন্য নম্বর দিয়ে ফেল করানো হয়। অনার্সের ফাইনাল ভাইভায় আমাকে ফেল করানো হয়।” মিম বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি তারা আমার গ্রামের বাড়িতে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আমার বাবা-মা অসুস্থ, তাদের ওপর প্রেশার করেছে অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য। অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় আমাকে বিভাগের রুমে কোনো মহিলা শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে দরজা আটকে জোর জবরদস্তি করা করা হয়েছে।” অভিযোগ করেও কেনো প্রতিকার না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি আজীবন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করিনি। কোন সংগঠনের সাথেও আমি জড়িত নই, আমি সাধারণ একজন ছাত্রী। আমি প্রতিবাদ করেছি বলেই আজ অনার্স ফেল। “কুপ্রস্তাবে রাজি না হয়ে অন্যায় করেছি বলে এখন আমার মনে হয়। আমি হয়ত অবন্তিকার মত সাহসী না, তাই হয়ত আত্মহত্যা করতে পারিনি। কে জানে এর পর আমি বেঁচে থাকব কি না। কিন্তু মূল্যহীন হয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।”

শিক্ষকরা কী বলছেন
মিমের অভিযোগ ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ দাবি করে প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন বলেন, “অবন্তিকার মৃত্যুতে তার সহানুভূতিকে পুঁজি করে সে (মিম) গণমাধ্যমের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে।” মিম অভিযোগ করার পর তদন্ত কমিটি আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনও দিয়েছিল। এই শিক্ষক তখন উচ্চ আদালতে যান। তিনি বলেন, “এরকম একটা বিষয় আদালতের বিচারাধীন থাকা অবস্থা মিম কীভাবে মিডিয়ায় কথা বলতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে আমি এ ব্যাপারে বেশি মন্তব্য করতে চাই না।” তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে আবু শাহেদ ইমন বলেন, ঠিক এই জায়গায় আমিও মীমের সাথে একমত। এমন একটা বিষয় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে কেন দুই বছরের অধিক সময় লাগবে? আমিও চাই খুব দ্রুত এ বিষয়টি মিটমাট হোক। মিমকে ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তার বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম বলেন “মিম ক্লাসই করত না। যেখানে ৬০ ভাগ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসতে পারে না, সেখানে মিম পরীক্ষা দিয়েছে। ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে তাকে নম্বর দেওয়ার তো কোনো সুযোগই নাই।” সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “মিমের ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন আমি যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটির বহিঃসদস্য ছিলাম তার বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি। সে যেন পরীক্ষা দিতে পারে সেটা দেখব।”


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page