‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে নতুন জোট গঠন করে গতকাল বুধবার দুপুরে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। বিকেলে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও (জাপা)। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, আগামী দু-তিন দিনে এভাবে অনেক দলের অবস্থান পাল্টাবে। আরও কিছু দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভোটে আসতে পারে ছোট দলগুলোর মধ্যে ইসলামপন্থী একাধিক দলের নাম রয়েছে। দলগুলো শিগগিরই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। তবে বিএনপির আলোচিত ও পরিচিত নেতাসহ অনেকেই দল ছেড়ে নতুন দুটি দলে (তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম) যুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে যে আলোচনা ছিল, তাতে এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো ফল আসেনি। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অসন্তুষ্টি রয়েছে। তাই শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ একটু পিছিয়ে হলেও বিএনপির আরও কিছু নেতা, আরও কিছু দলকে নির্বাচনে আনার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আগামীকাল শুক্রবার খেলাফত মজলিস (দেয়ালঘড়ি প্রতীক) ও পরদিন শনিবার বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (বটগাছ প্রতীক) কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সভা আছে। দল দুটির পৃথক ওই শুরার সভায় ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত এই দল দুটি পাঁচ–দলীয় জোট ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’-এর শরিক। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে এই জোটের সভা হয়।
সভা শেষে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’ জানিয়েছিল, বিরাজমান পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীন কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় জনমত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই।
খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে যাব না, এমন কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। সে দিনের (গত মঙ্গলবার) সভায় মূলত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ পর্যালোচনা হয়েছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
কয়েক বছর ধরেই সরকারি মহলের চেষ্টা ছিল, বিএনপির জোট থেকে শরিকদের বের করে দলটিকে রাজনৈতিকভাবে আলাদা করা। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামিক পার্টি, এনডিপি, এনপিপি, বাংলাদেশ ন্যাপসহ সাত-আটটি দল বিএনপির জোট ছাড়ে। গত বছরের ডিসেম্বরে বিএনপি ২০-দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে সমমনা ৩৬টি দল নিয়ে নতুন রাজনৈতিক মৈত্রী গড়ে। প্রায় ১১ মাস ধরে তারা নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করছে। এই মুহূর্তে সমমনা দলগুলো সরকারের পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবিতে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে রয়েছে। এর মধ্যেই গতকাল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি ও মুসলিম লীগ (শেখ জুলফিকার) আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিল। এ দুটি দলই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
এ ঘটনার উল্লেখ না করলেও গতকাল দলীয় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘যারা মনে করেছিল, কে আসে কে না আসে…ফুল কিন্তু ফুটতে শুরু করেছে। আরও অনেক ফুল ফুটবে। মনোনয়ন ফরম সরকারিভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া পর্যন্ত শত ফুল ফুটবে। কাজেই এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ছিলেন। গতকালই তাঁকে বহিষ্কার করে জোটের শরিক বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেনকে (সেলিম) নতুন মুখপাত্র করা হয়েছে। এই জোটের প্রধান সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা কারাবন্দী থাকায় জাগপার সহসভাপতি রাশেদ প্রধানকে ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক করা হয়েছে। জাগপার এই অংশটি ইবরাহিমের যুক্তফ্রন্টে যাওয়ার কথা ছিল। তারা একাধিক বৈঠকে অংশও নিয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নির্বাচনে আনার চেষ্টায় আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া, সংসদ সদস্য করার মতো প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে। আবার কিছু ইসলামপন্থী দলকে কোনো প্রলোভন ছাড়াই চাপ দেওয়া হচ্ছে দ্রুত নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইসলামি দলের একজন দায়িত্বশীল নেতা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ওপর চাপটা খুব নরমভাবে। শুধু বলছে, নির্বাচনে যাবেন কি না, সেটা আপনাদের ব্যাপার। তবে আপনাদের সহযোগিতা ছাড়াই যদি এই সরকার আবার ক্ষমতায় আসে, আপনাদের মামলা আছে, প্রতিষ্ঠান আছে—এগুলো মাথায় রাখবেন। তখন করার কিছুই থাকবে না।’
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, এখন তাদের লক্ষ্য চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদকে নির্বাচনে আনা। গণফোরাম আগামী শনিবার নির্বাচন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর বাইরে অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপিও আওয়ামী লীগের নজরে আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ছোট ৮-১০টি দল তফসিল ঘোষণার পরপরই ভোটে আসার ঘোষণা দেবে—এমন একটা ধারণা পেয়েছিল আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। এ জন্য এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তদের ব্যর্থতা দেখছেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো দায়িত্বশীল নেতা।
তবে মন্ত্রিসভার দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর নতুন করে আরও কিছু ঘোষণা আসবে। এর মধ্যে দল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থাকবেন।
অন্য দল ও নেতাদের ভোটে আনার ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি থাকায় মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমা কিছুটা পেছানোর কথাও ভাবা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে ভোটের তারিখ কোনোভাবেই পেছানোর পক্ষে নয় আওয়ামী লীগ।
গতকাল তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনের বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের। সময়সীমা কিন্তু আছে। এই সময়সীমা ঠিক রেখে তারা যদি সমন্বয় করে, সেটা নির্বাচন কমিশনের বিষয়।
বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপিতে এখন পর্যন্ত বিএনপি থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতা যোগ না দিলেও বিভিন্ন এলাকায় দলটির বহিষ্কৃত ও সাবেক নেতাদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও বগুড়ার আলোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শোকরানা অন্যতম। শোকরানা বগুড়া-১ আসনের (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।
আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, আখতারুজ্জামান কিশোরগঞ্জ-২ আসনে নির্বাচন করতে চান। তিনি গতকাল মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া বগুড়া-২ আসনে বিউটি বেগম ও বগুড়া-৭ আসনে সরকার বাদল মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। বাদল বগুড়া সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি। বিউটি বেগম বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক।
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে এক দফার আন্দোলন চলছে। বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নেবে না। যাঁরা মনোনয়নপত্র তুলেছেন বা ভবিষ্যতে তুলবেন, তাঁরা দলের কেউ নন।