সুন্দর প্রশস্ত রাস্তা, রাস্তার পাশে নয়নাভিরাম ফুলের গাছ ও আলোক সজ্জার জন্য সারা দেশে রাজশাহী মহানগরী অনেক সুনাম কুড়িয়েছে। সুন্দর শহর হিসেবে খ্যাত রাজশাহী মহানগরীর সেই সুনাম সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতার জন্য কিছুটা ম্লান হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিপাতেই নগরীতে দেখা যাচ্ছে জলাবদ্ধতা। গত ৫ অক্টোবর রাজশাহীতে বিগত ১০বছরের মধ্যে একদিনে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। এদিকে রেকর্ড বৃষ্টিপাতে নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকা, উপশহর হাউজিং এস্টেট এলাকা, তেরোখাদিয়া, বর্ণালীর মোড়, লক্ষীপুর এলাকা, ঘোষপাড়া, কাজিহাটা,সাহেব বাজার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, আমবাগান, হেঁতেমখা, তেরখাদিয়া, উপশহর, টিকাপাড়া, মঠপুকুর, শিরোইল, সিএনবি, বিনোদপুর, কাজলা, ভদ্রা, তালাইমারি, রামেক জরুরী বিভাগ, কয়ের দাড়া লেকসিটি, মালদা কলোনীর নিচু এলাকার কিছু জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে এছাড়াও নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর নিমজ্জিত হয়েছে।
এতে জন দুর্ভোগ দেখা দেয়।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বর্ণালী মোড়ে জলাবদ্ধ রাস্তায় স্থানীয়রা নৌকা চালাচ্ছেন। আরও কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে যেখানে দেখা যায় শহরের রাস্তায় স্থানীয়রা মাছ ধরছেন। এইদিকে মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে নেট পাড়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। জনগণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। সাধারণ জনগণ এর মতে অপরিকল্পিত নগরায়ন এই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী। অনেকের মতে বেপরোয়া ভাবে খাল ও পুকুর ভরাট করে বাড়ি নির্মাণও জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী।
বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালেই শহরে এক হাজারের বেশি পুকুর ছিল। এখন তা কমে দুইশোর নিচে নেমেছে। শহরের ৯৭ভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। যারফলে সামান্য বৃষ্টিপাতে নগরীতে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়া ভূমিদস্যুরা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পুকুর ভরাট করে নগর জীবনকে ঝুঁকিময় করে তুলেছে। অতি বর্ষণে রাজশাহী মহানগরীতে যেভাবে জল জটের সৃষ্টি হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে তার প্রধান কারণ পুকুর ভরাট। যে কারণে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে। বেআইনি ভাবে পুকুর ভরাট করে ভরাটকৃত জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদি জমি বা বসতভিটা দেখিয়ে সে সমস্ত ভরাটকৃত জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে বড় বড় বিল্ডিং।
অভিযোগ উঠেছে এমন বেআইনি কর্মকাণ্ডের সাথে ডিসি অফিসের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার। মূলত বেআইনি ভাবে পুকুর ভরাট করায় সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহীতে তাপদাহ বৃদ্ধি, খরা ও সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এই জলাবদ্ধতার পেছনে৷ আরও বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। ৩-৪ বছর ধরে আবর্জনা ও পলিথিনে ভরে যাওয়া ড্রেনগুলো পরিষ্কার না করা, পুকুর-ডোবার মতো জলাশয় ভরাট করে দেওয়া, অপরিকল্পিতভাবে ড্রেন, রাস্তা ও ভবন নির্মাণ এবং সড়ক পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কারের সময় উচ্চতা ও ঢাল বিবেচনায় না নিয়ে ক্রমাগত উঁচু করা এই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে সিটি করপোরেশন বলছে, যত্রতত্র বাড়ি নির্মাণের জন্য ড্রেনের ওপর বালু ফেলে রাখা, ড্রেনগুলো চার বছর ধরে পরিষ্কার না করা, পানি নির্গমনের খালে বাঁধ দিয়ে পাট জাগ দেওয়ার কারণে শহর জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে পদ্মা নদী থেকে শহরের ভেতর দিয়ে উত্তর পাশের বারোনই নদে পানি নেমে যাওয়ার জন্য আটটি বড় ড্রেন করা হয়েছিল। এই বড় ড্রেন ছাড়াও অলিগলির ড্রেন মিলে শহরে মোট ২২২ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। গত চার বছর ধরে ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়নি। দরপত্র আহ্বান করে এই ড্রেন পরিষ্কার করা হয়।
এদিকে বড় আটটি ড্রেনের পানি একটি খাল দিয়ে শহরের উত্তর পাশের বারোনই নদে গিয়ে পড়ে। অনাবৃষ্টির সময় স্থানীয় লোকজন এই খালে বাঁধ দিয়ে পাট জাগ দিয়েছিলেন এবং খালের পানি দিয়ে জমিতে সেচ দিয়েছিলেন। এসব কারণে শহরের পানি নিষ্কাশিত হতে দেরি হয়েছে। এদিকে জলাবদ্ধতার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দুষলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফি উদ্দিন। তিনি বলেন, গত দশ বছরেও সড়কের নিচ দিয়ে বড় মোটা পাইপে সুয়ারেজ লাইন করতে ওয়াসা ব্যর্থ হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা না মেনে শত শত পুকুর ভরাট করা হয়েছে। পদ্মার বাঁধে ব্রিটিশ আমলের স্লুইসগেটগুলো থেকে নগরের উত্তরে প্রবাহিত ড্রেনগুলো ছোট করে ফেলে জনগণকে জায়গা দখলের সুযোগ করে দেওয়া এবং পানিপ্রবাহের গতি ধীর করা হয়েছে। ২৫ বছর আগে নগরের ড্রেনেজ প্রকল্পের এই ভুলের ওপর ভিত্তি করেই আজও প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনেজ প্রকল্প চলছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ১০০ বছরের উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা না করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করা হচ্ছে উল্লেখ করে আহমদ সফি উদ্দিন আরও বলেন, সড়ক পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের সময় নিয়মানুযায়ী উচ্চতা ও ঢাল অনুরূপ না রেখে বছর বছর উঁচু করায় নগরজুড়ে ড্রেনের ঢালও এলোমেলো হয়ে গেছে। বাড়ি নিচু হয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। আরেকটি হচ্ছে উন্নয়ন পরিকল্পনা করার আগে বিধিমোতাবেক বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ নাগরিকদের পরামর্শ গ্রহণে ব্যর্থতা এবং জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের উদাসীনতা রয়েছে।দ্রুত নগরের পানি না নামার আরও কিছু কারণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নগরবাসীর ফেলা আবর্জনা ও পলিথিনে ড্রেনের পানিপ্রবাহ বাধা পায়। নগরের উত্তরের খাল–বিল–নদী ভরাট, দখল ও বেআইনি স্থাপনার কারণে পানি নামতে বাধা পায়।
নীতিমালা না মেনে ভবন নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে আরডিএর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতাকেও দুষলেন তিনি।রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. অনুপম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শহরে পানি যখন আটকেছে তখন বুঝতে হবে এখানকার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক দুর্বল। স্বাভাবিকভাবে বিষয়টা এমন হতে হবে যে, ছোট ছোট ড্রেনগুলো ক্রমশ ঢাল হয়ে বড় নালায় মিলিত হবে এবং এভাবে পানি নেমে যাবে। সেটা হচ্ছে না বলেই জলাবদ্ধতা হয়েছে। ড্রেন শুধু নির্মাণ করলেই হবে না, পরিকল্পনামাফিক নির্মাণ করতে হবে। নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।”
মূলত বেআইনিভাবে পুকুরভরাট, সংকীর্ণ ড্রেন, অনেক বছর ধরে ড্রেন পরিষ্কার না করা, অতিকল্পিত নগরায়ন রাজশাহী মহানগরীর জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী।
এব্যাপারে মহানগরীর বোয়ালিয়া জোনের সহকারী কমিশনার (ভুমি) মো: শাহিন মিয়া মুঠোফোনে বলেন, পুকুর ভরাটের বিষয়ে খবর পেলে বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন হয়। পুকুর ভরাটের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট যারা জড়িত আছে তথ্য দিলে আমরা ইনশাআল্লাহ ব্যবস্থা নিবো।
এবিষয়ে জানতে রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ কে একাধিকবার ফোন দিয়ে রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জ/ন