সোহেল রানা, নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জে পরিবেশ দূষণের অন্যতম ক্ষেত্র ইটভাটা। এসব ইটভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যে পরিবেশ বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন।
অন্যদিকে ইটভাটাগুলোতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শিশুশ্রম আইনকে তোয়াক্কা না করে শিশুদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন ভাটার মালিকরা। ইটভাটার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মজুরি বৈষম্যেরও শিকার হচ্ছে এ শিশুরা। পুড়ছে তাদের অনাগত সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
সেই সাথে শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য নেই আর্সেনিক মুক্ত পানির ব্যবস্থা, নেই কোন স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, ব্যবহার করতে হচ্ছে ঝুপড়ি দিয়ে গড়ে উঠা টয়লেট। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে এলেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসনের কঠোরতার অভাবকে পুঁজি করে ‘অবৈধ’ ইটভাটা চলছে বছরের পর বছর। তবে অবৈধ ইটভাটা বন্ধসহ বৈধ ইটভাটাগুলোকে সরকারের নিয়মের আওতায় পরিচালনা করতে নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান জেলা প্রশাসক।
জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জে ২৯৪টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে ১২৮টি ইটভাটা ছাড়পত্রবিহীন অবৈধভাবে ব্যবসা করছে। তবে নবায়ন ছাড়া অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা আরও বেশি। এসব অবৈধ ইটভাটার মধ্যে সর্বাধিক ইটভাটা রয়েছে সদর ও রূপগঞ্জ উপজেলায়। পুরো জেলার মধ্যে অবৈধ ইটভাটা সদর উপজেলায় রয়েছে ৩৯টি, রূপগঞ্জে ৬৯টি, আড়াইহাজারে ৭টি, বন্দরে ১২টি, সোনারগাঁয়ে ১টি।
এসব ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত চুল্লি থেকে নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও ইটের গুঁড়ো বাতাসের সঙ্গে মিশে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে। ফলে গাছপালা মরে যাওয়া, জমিতে ফসল না হওয়াসহ নদীতে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। পাাশাপাশি শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরের পর বছর ভুগছে শিশুসহ সব বয়সের মানুষ।
বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও কিছুদিনের মধ্যে আবারও চালু হয় অধিকাংশ ইটভাটা। কড়া হুঁশিয়ারি, জরিমানা ও মামলা করেও এসব ইটভাটা বন্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন।
সরেজমিন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলি ইউনিয়নের বক্তাবলি ঘাট সংলগ্ন মেসার্স নবীন ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারিং (এনবিএমব্রিকস ফিল্ড) নামে একটি ইট খোলায় গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটা শ্রমিকের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া ২৫-৩০ জন শিশু কাজ করছে। ওদের বয়স ৭ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে।
এখানে কয়লার পরিবর্তে সংরক্ষিত বনের কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। ফসলি জমি গভীরভাবে খনন করে সেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। মাটি ব্যবহার করা হলেও সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নীরব বলে জানায় স্থানীয়রা। নির্বিচারে ফসলি জমি কাটার ফলে পরিবেশ ভারসাম্যও হারাচ্ছে।
কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব শিশুর কেউ কেউ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ছে। আবার কেউ কেউ এখন আর বিদ্যালয়ে যায় না। কেউ বা কখনো বিদ্যালয়ের মুখই দেখেনি।
কেউ নিজে থেকেই, আবার কেউ মা-বাবার সঙ্গে ইটভাটার কাজে এসেছে। কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে এবং মাথায় করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহন করাসহ সব কাজেই নিয়োজিত এসব শিশু। তাছাড়া অনেকে চুল্লিতে কয়লা বা কাঠ দেওয়ার কাজও করছে যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
তারা আরো জানায়, প্রতি হাজার ইটে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। যেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকরা একদিনে ১ হাজার ইট বহন কওে সেখানে এই সব শিশুরা কেউ দুই দিন বা কেউ চারদিনে হাজার ইট টানে। তাতে তারা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে পায় আর সেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকরা পাচ্ছেন ৪৫০-৫৫০ টাকা। মজুরি সাশ্রয় করতে আইন অমান্য করে এভাবে শিশুদের কাজে লাগাচ্ছেন ভাটার মালিকরা। শুধু এই ইটভাটায় নয় অন্যান্য ইটভাটা গুলোতে দেখা যাচ্ছে এই একইচিত্র।
এ বিষয়ে এনবিএম ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী আবুল শিশু শ্রমের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এখানে কোন শিশুদের কাজ করানো হচ্ছে না। আমরা তো তাদের দাদনই দেই নাই। হয়তো তাদের মা বাবা কাজ করে তারা তাদেও সাথে খুশির বিষয়ে কাজ করছে। তাদের মা বাবার টাকার সাথে তাদের টাকা দেয় সর্দাররা।
মানব দেহে অবৈধ ইটভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোয়ার ক্ষতিকর প্রভাব জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মশিউর রহমান বলেন, ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও ঠান্ডাজনিত নানা রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু ও বয়স্কদের উপর দূষিত বায়ুর সর্বাধিক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ইটের ভাটার বিষাক্ত বায়ু থেকে রক্ষায় সরকারের নির্দেশিত আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ইট প্রস্তুত করতে হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ মহাপরিদর্শক ডা. রাজীব চন্দ্র দাস, আমরা পরিদর্শনে ইটভাটা গুলোতে যাই তখন যদি কোন শিশু শ্রমিকদের কাজ করতে দেখি তখন সেই ইটভাটাগুলোকে নোটিশ দিয়ে আসি।
আমরা সাধারণ যখন যাই তখন তারা আমাদের যাবার খবর পেয়ে সাবধান হয়ে যায়। যেহেতু শিশু শ্রমিকদের কাজ করা নিষেধ এবং আপনেরা গিয়ে দেখেন আমরা আমাদের ইন্সপেক্টর পাঠাবো পরিদর্শনে তারপরও তাদের নোটিশ দিয়ে এর ব্যবস্থা নিবো।
পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে ফতুল্লার বক্তাবলী ও এনায়েতনগর ইউনিয়ন ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মো. শওকত আলী জশিশুদের ইভাটায় কাজের বিষয়টি জানা নেই বলে তিনি জানান, সরকারি বিধি নিয়ম মেনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার চেষ্টা করছেন তারা।
তিনি আরও বলেন, যদি আরও কোন উন্নত প্রযুক্তি থাকে তাহলে আমরা সেভাবেই ইটভাটা পরিচালনা করব। যদি না পারি তবে ব্যবসা বন্ধ করে দিব।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন এ বিষয়ে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জে ইটভাটার সংখ্যা তিনশ এর কাছাকাছি। নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল সংকট রয়েছে, তবুও আমরা আমাদের সাধ্যমত অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে নিচ্ছি। কিন্তু আমরা ইটভাটার চিমনি ভেঙ্গে দিয়ে আসলে ইটভাটার মালিকেরা সপ্তাহখানেকের মধ্যে আবার গড়ে তুলে।
আর আমদের জনবল এতোটাই কম যে নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায় একটা ইটভাটা পরিদর্শন করে পর্যায়ক্রমে পরবর্তীতে সেটা পুনরায় পরিদর্শন করতে আমাদের বছর পেরিয়ে যায়।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ জানান, শিশু শ্রমসহ পরিবেশ দূষণ রোধে ইটভাটা নিয়ন্ত্রনে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও নিয়মিত অভিযান পরিচালনাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমান আদালতও পরিচালনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আমাদের কার্যক্রম চলছে।
তারিখ : ১৯-০৫-২০২৩