নজরুল ইসলাম জুলু: রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের বোয়ালিয়া মডেল থানার এসআই আবু হায়দার বর্তমানে বোয়ালিয়া মডেল থানার অন্তর্গত মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসাবে কর্মরত।
এসআই আবু হায়দার রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশে প্রায় ৭ বছর যাবৎ কর্মরত আছেন । এ ৭বছরে তার বিরুদ্ধে উঠেছে বিভিন্ন অভিযোগ। বিভিন্ন অভিযোগের কারণে ২০২২ সালে তাকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হলেও আবারো তিনি কয়েকদিন পরেই বহাল তবিয়তে ফিরে আসেন নিজ কর্মস্থলে। বিষয়টি অনেকটা এরকম যে, রাজশাহী মালোপাড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই হায়দার সকল আইনের ঊর্ধ্বে এবং তিনি যেন অঘোষিত সর্বসেরা।
বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সরকারবিরোধী নাশকতাকারীদের সাথে গভীর সক্ষতার । মূল অপরাধীদের আড়াল করে বোয়ালিয়া থানার বিভিন্ন এলাকায় নিরপরাধ মানুষদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই গ্রেফতার করে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে হায়দার ছাড়াও ডজন খানেক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন এসআই হায়দার।
গত ৯ ডিসেম্বর শনিবার আনুমানিক রাত সাড়ে ৮ টার সময় কেঁদুর মোড়ে আমজাদ হোসেনের ছেলে আনারুল ইসলামের চায়ের দোকানে ৫৫০ টাকার চা-নাস্তা করেন, ওই ফাঁড়ির এএসআই মামুন ও এ টি এস আই মিনারজুল। কিন্তু বিল পরিশোধ করেন না। সেই সময় তারা আনারুলের সাথে কুশল বিনিময় করেন এবং ফোন নম্বর আদান প্রদান করে তাকে বলেন, যে কোন তথ্য থাকলে আমাদেরকে জানাবেন।
এর কিছুক্ষণ পরে এসে তারাই আনারুল কে বিএনপির কর্মী অজুহাত দেখিয়ে আটক করে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন আনারুলের দুই ছেলে রাজন ও সজল। রাজন ও সজল জানান, প্রথমে তারা আমার আব্বাকে বলেন, আপনাকে ওসি সাহেবের সাথে একটু দেখা করতে হবে। রাজন ও সজল আরো অভিযোগ করে বলেন, এর আগেও আমার আব্বাকে একই অভিযোগে দুইবার নিয়ে যায় । গত ৬ নভেম্বর ২০২৩ এ আমার আব্বাকে আটক করে পরে জিজ্ঞাসাবাদে কোন কিছু না পাওয়ায় ৭ নভেম্বর ২০২৩ এ আরএমপিও ৭৮ ধারায় চালান করে। ঐদিনই আমার আব্বা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পায়। এবারও আমার আব্বাকে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়ায় আটক করে এবং ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে মোটা অংকের অর্থ দাবি করেন তারা।
আনারুল কে আটকের বিষয়টি এসআই হায়দার আলী স্বীকার করেন এবং বলেন, আটকের সময় আমি ছিলাম না তবে আমার টিম ফাঁড়ির এএসআই মামুন ও এটিএসআই মিনারজুল তাকে থানায় নিয়ে এসেছে। ঠিক কী অভিযোগে আনারুলকে আটক করা হয়েছে তা জানতে চাইলে এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি। আটক বিষয়ে তিনি সেকেন্ড অফিসার ইফতেখার আলম এর সাথে কথা বলতে বলেন, এবং আরও বলেন, ইফতেখার আলম স্যার বললে আমি ছেড়ে দিব।
এ বিষয়ে বোয়ালিয়া মডেল থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই ইফতেখার আলম এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে হায়দারের সাথে কথা বলে জানবো যে, ঠিক কিসের ভিত্তিতে আবারো আনারুল কে আটক করা হলো। আনারুলের আটকের বিষয়ে ওসি তদন্ত আমিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,”এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।” তবে এ বিষয়ে ডিউটি অফিসার এএসআই রেজাউল করিম মুঠোফোনে জানান আনারুল কে ১৬ নভেম্বর ২০২৩ পূর্বে ঘটিত বোয়ালিয়া থানা মামলা নং ২৬ এ গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনি আরোা বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক মামলা। আনারুল এজাহার ভুক্ত আসামি কিনা জানতে চাইলে এএসআই রেজাউল করিম বলেন, আনারুল এজাহার ভুক্ত আসামি নন।
পরবর্তীতে আনারুলকে উক্ত মামলায় অজ ১০ ডিসেম্বর রবিবার চালান করা হয় বলে জানা গেছে। গত ১ মাসে আনারুল কে এ নিয়ে ৩ বার মিথ্যা অভিযোগে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে আনারুলের ছেলেরা।
জোড়ালো অভিযোগ উঠেছে বিগত কয়েকমাসে সরকারবিরোধী নাশকতার সাথে জড়িত মিথ্যা অভিযোগে অনেক নিরপরাধ মানুষকে এস আই আবু হায়দার আলী ও তার সহযোগী কিছু পুলিশ কর্মকর্তারা আটক করেন বা আটকের ভয় দেখান। পরবর্তীতে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে আরএমপিও ৭৮ ধারায় চালান করে থাকেন এবং টাকা না দিলেই ফাঁসানো হয় পুরনো মামলায়। শুধু হায়দার নয় বোয়ালিয়া থানায় অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা চলছে একই সিস্টেমে।
এসআই আবু হায়দারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়।
উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালের জুন মাসের ১ তারিখে মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে রিয়াদ নামের ১ জন আসামীকে ৪ তলা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়ার অপচেষ্টা করলে এসআই আবু হায়দার ও কন্সটেবল রায়হানকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। ওই সময় বিষয়টি রাজশাহী মহানগরীতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে৷ এ খবর ছাপা হয়। অদৃশ্য কিংবা অশুভ শক্তির ইশারায় তিনি আবারোও কর্মস্থলে যোগদান করে এখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আছেন।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে এসআই আবু হায়দার ও তার টিম রাজশাহী উপশহর এলাকায় নাটকীয় তল্লাশী চালিয়ে রাত সাড়ে ৩ টায় রাজশাহী উপশহরের ৩ নং সেক্টরের ৪ নং রোডের ১৭৭ নম্বর বাসা থেকে ৩টি ম্যাগজিন, ৩২ রাউন্ড গুলি ও ৬ রাউন্ড গুলির খোসাসহ ১টি বিদেশী পিস্তল এবং ৯০ রাউন্ড শটগানের গুলি ও ১২ রাউন্ড গুলির খোসাসহ ১টি শটগান, ১টি প্রাইভেট কারসহ ওয়াহিদ মুরাদ জামিল ওরফে লিংকন (৫৬) এবং সজল আলীকে (২৪) গ্রেফতার করেন।
পরবর্তীতে মুরাদ জামিল ওরফে লিংকন এবং সজল আলী জানায় এ সকল অস্ত্রের লাইসেন্স আছে কিন্তু তারপরেও এসআই হায়দার আলী প্রাথমিক ভাবে অস্ত্রের লাইসেন্সের কথা গণমাধ্যমের কাছে অস্বীকার করেন এবং বড় ধরনের অস্ত্রের চালান আটক করেন মর্মে সাংবাদিকদের জানান। কিন্তু পরিশেষে জানা যায়, প্রকৃত ঘটনা ছিল ব্যবসায়ীর সাথে আরেক ব্যবসায়ীর দ্বন্দের জেরে এসআই হায়দার আলী তাদের গ্রেফতার করে বাহবা কুড়ান এবং সেই সাথে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে ওয়াহিদ মুরাদ জামিল ওরফে লিংকনের কাছে পরবর্তীতে মামলায় ধারা কমানোর কথা বলে উৎকোচ গ্রহন করেন।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে এসআই আবু হায়দার রাজশাহী মতিহার এলাকার হাসিব নামের এক ব্যাক্তিকে ৫০ পিচ ইয়াবা সহ আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে এসে মুক্তিপন হিসেবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেন এবং আরএমপি মামলায় চালান করে দেন ( আরএমপির প্রেস নোটিসে উক্ত মামলার তথ্য সংরক্ষিত আছে)। পরবর্তীতে টাইলস ব্যবসায়ী হাসিব জানান – আমি বিনোদনপুর বাজার থেকে অটো রিক্সায়
জিরো পয়েন্টে যাচ্ছিলাম, এমন সময় হঠাৎ রাজশাহী গ্রামীন ফোন অফিসের সামনে আমার পাশে বসা ১ জন যাত্রী নেমে যান এবং অটো ১০০ গজ সামনে গেলেই আমার অটোরিক্সা থামিয়ে এসআই হায়দার আলী চেক করে আমার পাশের সিট থেকে ইয়াবা উদ্ধার দেখান। ঐ সময় আমি পুরো ঘটনা বুঝে চুপচাপ থাকি এবং এসআই হায়দারের কথায় সাঁয় দিয়ে যা করতে বলে তাই করি। পরে আরএমপি মামলায় জামিনে মুক্ত হয়ে জানতে পারি আমাকে টার্গেট করেই সোর্সের মাধ্যমে আমার পাশের সিটের যাত্রী পরিকল্পিতভাবে ইয়াবা অটো রিক্সার রডে গুঁজে রেখে দিয়েছিল । আর আমার পাশে বসা সেই যাত্রী ছিল এসআই আবু হায়দারের সোর্স।
অনুসন্ধানে জানাগেছে রাজশাহী বোয়ালিয়া মডেল থানার দূর্নীতির কারন বিতর্কিত অফিসার ইন্চার্জ (ওসি) সোহরাওয়ার্দী হোসনের প্রধান সহযোগী হিসাবে কাজ করেন মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই হায়দার আলী সহ উপ পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) চার পুলিশ কর্মকর্তা । গ্রেফতার বানিজ্য ছাড়াও অবাসিক হোটেলে টাকা আদায়, মাদকব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী, কিশোর গ্যাং কাছে মাসোয়ারা আদায় এবং রাজশাহী সাহেববাজার ফুটপাতের প্রতিটি দোকান থেকে চাঁদা আদায়ও করে থাকেন এ পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সোহরাওয়ার্দী হোসন।
পুলিশ বাহিনীকে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে, বিপদে তাদের সহায়তা চায়, সেই বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কারণে পুলিশের অনেক প্রশংসামূলক কর্মকাণ্ড ধামাচাপা পড়ে যায়। পুলিশ সদস্যদের এভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা পুলিশের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করছেন রাজশাহীর অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা।