• সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১২ পূর্বাহ্ন

নামেই ‘ঝুম নিয়ন্ত্রণ’ জুম বানানই ভুল!

অনলাইন ভার্সন
অনলাইন ভার্সন
আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৩

চৌধুরী হারুনুর রশীদ, রাঙামাটি \
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বনভূমি সুরক্ষার জন্য ঢালু পাহাড়ে বিশেষ পদ্ধতির চাষাবাদ ‘জুম চাষ’কে নিরুৎসাহিত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ। প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়ে কেবলমাত্র একটি ধাপে ৪৬১ জুম চাষীকে নিরুৎসাহিত কার্যক্রমের আওতায় পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রণোদনা দিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ। কেবলমাত্র একবারে জন্যই যেন এই উদ্যোগ নিয়েছে: এরপর আর কোনো কর্মসূচির আওতায় আসেননি পাহাড়ের প্রান্তিক জুম চাষীরা।
জুম গবেষকরা মনে করছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘ঝুম নিয়ন্ত্রণ’ বন বিভাগের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। যে লক্ষ্য এই বিভাগটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সে লক্ষ্যে কোনো অবদান পারেনি ‘ঝুম নিয়ন্ত্রণ’ বন বিভাগ। জুম নিয়ে নিজেদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম নেই বলেও স্বীকার করেছে বিভাগটি। বর্তমানে বিভাগটির মোট জনবলের এক তৃতীয়াংশ নিয়োজিত থাকলেও জুম নিয়ে কোনো কার্যক্রম নেই প্রকল্প না থাকার অজুহাতে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বিশেষায়িত চাষাবাদ পদ্ধতি জুম চাষ দীর্ঘকাল ধরেই করছেন পাহাড়ের জুমিয়া পরিবারগুলো। পাঠ্য পুস্তককেও উল্লেখ রয়েছে এই বিশেষ পদ্ধতির কথা। তবে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদের বিপক্ষে অবস্থানে রয়েছেন পরিবেশবাদীরা। পরিবেশবাদীদের মতে, জুম চাষের ফলে পাহাড়ে একদিকে বন কমছে, অন্যদিকে পাহাড়কে ন্যাড়া করার কারণে পাহাড়ের ভূমি ক্ষয়ের পাশাপাশি জুমের ফসল তোলার পর পাহাড়ে আগুন দেওয়ার কারণে জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি হচ্ছে। এসব বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে মূলত পাহাড়ের বন সুরক্ষায় জুমিয়াদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এই বিভাগটির প্রতিষ্ঠা। জুম বানানটি পাঠ্য পুস্তকেও ‘জুম’ উল্লেখ থাকলেও বন বিভাগের ‘ঝুম’ বানানটিকে ভুল দাবি করে আপত্তি রয়েছে অনেকেই।

ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬২ সালে ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ প্রতিষ্ঠার করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে ঝুম নিয়ন্ত্রণের একটি প্রকল্পের আওতায় ৪৬১টি জুমিয়া পরিবারকে জুম আবাদের নিরুৎসাহিত করার অংশ হিসেবে প্রণোদনা দেয়া হয়। এরপর জুমিয়াদের জন্য নতুন করে কোনো উদ্যোগ বা প্রকল্প নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। বিগত প্রায় ৪ দশক ধরে নামেই ‘ঝুম নিয়ন্ত্রণ’ হিসেবে টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কী পরিমাণ জুম ভূমি বা ঢালু পাহাড়ি জমি রয়েছে; সেটিরও কোনো পরিসংখ্যা নেই প্রতিষ্ঠারটির কাছে। যদিও তারা বলছেন এখনো ডাটাবেস তৈরির কাজ চলছে!

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙামাটি অঞ্চলের তথ্যমতে, রাঙামাটি জেলায় ১২ হাজার ৭৯৯ হেক্টর, খাগড়াছড়ি জেলায় ১০ হাজার ৮০৩ হেক্টর এবং বান্দরবান জেলায় ১৩ হাজার ৪১৫ দশমিক ৫ হেক্টর জুম ভূমি রয়েছে। ডিএই’র হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম ভূমির পরিমাণ ৩৭ হাজার ১৭ দশমিক ৫ হেক্টর। ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ বলছে, জুম নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো কার্যক্রম না থাকলেও বিভাগটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুরক্ষাসহ পারমিট কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন মৌজার অধীনে রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় ৬ হাজার ৩২৯ একর ও খাগড়াছড়ি জেলায় ১৮ হাজার ২৪৯ একর সংরক্ষিত বন রয়েছে। এছাড়া রাঙামাটির ২৯ হাজার ৮৫৩ একর ও খাগড়াছড়ির ১ হাজার ৮২৫ একর ভূমি সংরক্ষিত বন গড়ে তোলার নির্বাচিত ও অধিগ্রহণের কাজ চলমান রয়েছে। অধিগ্রহনের কাজ সম্পন্ন হলে পূর্বের ২৪ হাজার ৫৭৮ একর সংরক্ষিত বনসহ মোট ৫৬ হাজার ২৫৬ একর ভূমি তাদের সংরক্ষিত বন থাকবে।

বন সংরক্ষক রাঙামাটি অঞ্চল দপ্তর সূত্র জানায়, ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন আটটি রেঞ্জ কার্যালয় রয়েছে। রেঞ্জসমূহ হলো- বীজ ও বীজতলা রেঞ্জ, ফুলগাজী রেঞ্জ, খাসখালী (কাঁশখালী) রেঞ্জ, উল্টাছড়ি রেঞ্জ, হাজাছড়ি রেঞ্জ, মেরুং রেঞ্জ, তিনকুনিয়া রেঞ্জ ও কুতুবদিয়া রেঞ্জ। রেঞ্জসমূহের সেবাদান ও কর্মপরিধির মধ্যে রয়েছে চারা বিক্রয় ও বিতরণ, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা; বন ও বনায়ন এবং বনজ সম্পদের ক্ষতি না করার বিষয়ে পরামর্শ প্রদান, বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধকরণ; অংশিদারিত্বের মাধ্যমে বনায়ন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা, গণশুনানি, জোতপারমিট সংক্রান্ত কার্যক্রমে পারমিটকারীদের সহযোগিতা প্রদান। আবার ঝুম নিয়ন্ত্রণ বিভাগের আটটি রেঞ্জ আওতাধীন বিভিন্ন পদে ২২৯টি জনবল পদ রয়েছে; তন্মধ্যে ৭৯ নিয়োজিত আছেন। মোট জনবলের হিসাবে প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনবল রয়েছে এই বিভাগে।

জুম সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ঢালু পাহাড়ের পাদদেশে গাছ-গাছালি কেটে আগুনে পুড়ে তৈরিকৃত জমি বা পাহাড়ে চাষাবাদ করার পদ্ধতিকে জুম চাষ বলা হয়। জুম চাষ এক ধরণের স্থানান্তরিত কৃষি পদ্ধতি; বন বিভাগ জুম চাষকে ‘ঝুম চাষ’ বলে থাকে। জুম চাষ সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদ প্রথা। তবে এটি বর্তমানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তায় যোগান দিয়ে আসছে। জুমের ফসল উত্তোলনের পর ক্ষেতে আগুন দেওয়ার কারণে পাহাড়ের গাছপালা ও কীটপতঙ্গ পুড়ে যাওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্য বিপদাপন্ন হয়ে পড়া ও বনভূমির পরিমাণ কমে আসায় পরিবেশবাদীদের জুমে চাষ পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি থাকলেও স্থানীয় অধিবাসীদের খাদ্যনিরাপত্তা ও বিকল্প খাদ্য যোগানোর সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় এই চাষাবাদ পদ্ধতি এখনো গুরুত্ববহ। যদিও জুম চাষে নিরুৎসাহিত করা ও চাষীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি দৃশ্যত প্রভাব ফেলেনি।

পরিবেশবাদীরা মনে করেন, জুম চাষকে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নামমাত্র হলে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না এবং হয়নিও। জুমিয়াদের পুনবার্সন, বিকল্প আয় বা খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে চাষীদের জুম বিমুখ করার ভাবনা অদূরদর্শী ও অফলপ্রসূই হবে। বন বিভাগ নামমাত্র একটি প্রতিষ্ঠা খুলে রাখলেও কোনো কার্যক্রম না থাকায় সেই প্রতিষ্ঠানটিও প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।

বর্তমান সময়ে ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন উন্নয়নকর্মী ও জুম গবেষক তনয় দেওয়ান। তিনি বলেন, জুম চাষীদের পুনর্বাসনের কোনো প্রজেক্ট তাদের (বন বিভাগ) মধ্যে নেই। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সেগুন বাগান সৃজন করার জন্য তারা জুম চাষীদের তখন ব্যবহার করেছে; এখন তো কোনো বনায়ন কার্যক্রম নেই। সামাজিক বনায়নে তাদের কোনো কার্যক্রমও নেই, আর সামাজিক বনায়ন জুম নিয়ন্ত্রণের অধীনেও নয়। প্রকৃতপক্ষে জুম নিয়ন্ত্রণ বিভাগের এখন আর কোনো কাজ নেই। ব্রিটিশ আমলে করা সংরক্ষিত বনের জন্য প্রয়োজন হলেও এখন অপ্রাসঙ্গিক। তারা যদি প্রকৃতপক্ষে জুম চাষীদের পুনবার্সন করে বন ভূমি রক্ষা করাসহ নানাবিধ কার্যক্রম করতো তাহলে সেটি ভালো হতো। এখন জুম নিয়ন্ত্রণ বিভাগ আসলে কী করে আমরাও কিছু জানি না। জুম নিয়ে কাজ করার পর দেখলাম পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক জুম চাষ নিয়ে স্থানীয় জেলা পরিষদেরও একটি বিষয় হয়ে ওঠে জুম চাষ। কিন্তু এখন জেলা পরিষদ, কৃষি বিভাগ- কারোই জুম চাষ নিয়ে কোনো প্রোগ্রাম নেই, এখানে জুম চাষ হলেও কেউই দায়িত্বশীল নয় বলে মনে করেন এই গবেষক।

জুম চাষ নিয়ে কোনো কার্যক্রম নেই- বিষয়টি স্বীকার করেই ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. মো. জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন, ‘১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে এক বারই ৪৬১ জনটি জুমিয়া প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল। এরপর প্রকল্পটি আর কন্টিনিউ না হয়নি। বাস্তব কথা হলো এখন দৃশ্যত আমাদের জুম নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যক্রম নেই। তবে আমরা বন রক্ষায় জুম নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।’ তিন পার্বত্য জেলায় কী পরিমাণ জুম ভূমি রয়েছেÑ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কি পরিমাণ জুম ভূমি রয়েছে; এর সঠিক তথ্য আমাদের বিভাগের কাছে নেই। তবে ডাটাবেস তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।’#


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ