নজরুল ইসলাম জুলু:
নওগাঁর আত্রাইয়ে অনাবৃষ্টিতে কমে গেছে নদী-নালা-খাল-বিলের পানি। ফলে দেখা দিয়েছে দেশীয় মাছের সংকট। বিপাকে পড়েছেন মৎস্যজীবীরা। ভিন্ন পেশায় ঝুঁকছেন অনেকে। আবার শুঁটকি ব্যবসায়ীরাও মাছ না পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। মাছের অভাবে ফাঁকা পড়ে আছে অধিকাংশ চাতাল। মৎস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত জেলার আত্রাই উপজেলা। এ উপজেলায় প্রায় শতাধিক জলাশয় আছে। এখানকার দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুঁটকির কদর আছে দেশজুড়ে। ভারতেও রপ্তানি হয়। বিজ্ঞাপন বন্যা না হওয়ায় তবে গত দুবছর থেকে আগেই নদী ও খাল-বিলের পানি কমে গেছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট পড়েছে। তাই বেশি দাম দিয়ে মাছ কিনতে হচ্ছে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের। খরচ বেড়ে যায় বিপাকে পড়েছেন তারা। স্থানীয় ও উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ২৬ শুঁটকি ব্যবসায়ী আছেন। এর সঙ্গে জড়িত আছেন ৮০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক। উপজেলায় মৎস্যজীবী আছে ১ হাজার ৭৫০ জন। বিজ্ঞাপন আষাঢ় থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত চলে শুঁটকির কারবার। এ সময় দম ফেলারও সময় পান না শুঁটকি ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। এখানকার শুঁটকি সৈয়দপুর, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, জামালপুর ও ঢাকায় সরবরাহ হয়ে থাকে। শুঁটকি তৈরি ও বাজারজাত করে যে আয় হয় তা দিয়েই চলে সারাবছর। কিন্তু এ বছর তার উল্টো চিত্র। মাছ সংকটে পড়েছে শুঁটকি পল্লী। দেশীয় মাছ সংকট, ফাঁকা শুঁটকি পল্লীর অধিকাংশ চাতাল আত্রাই রেলস্টেশন সংলগ্ন ভরতেঁতুলিয়া গ্রামটি মূলত শুঁটকির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও আত্রাই আহসানগঞ্জ রেল লাইনের দুপাশে ও কেডিসি সংলগ্ন এলাকায়ও চাতালে মাছ শুকানো হতো। এসব এলাকা ঘুরে দেখা
গেছে, কয়েকটি চাতালে অল্প পরিমাণ মাছ শুকানো হচ্ছে। আছে শুধু পুঁটি ও টাকি মাছ। অধিকাংশ চাতালই খালি পড়ে আছে। শ্রমিকও কম। যারা আছেন তারাও অলস সময় পার করছেন। বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে দেশীয় জাতের মাছের আমদানি কম। বেশি দামে মাছ কিনতে হচ্ছে। এত দাম দিয়ে মাছ কিনে ব্যবসায়ীদের পোষাবে না। তাই এ বছর শুধু পুঁটি আর টাকি মাছ কিনে শুকানো হচ্ছে। ভরতেঁতুলিয়া গ্রামের শুটকি ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ‘এক কেজি পুঁটি ৬৫-২০০ টাকা কেজিতে আড়ত থেকে
কিনতে হয়। এছাড়া প্রতিকেজিতে আড়তদারকে দিতে হয় ২ টাকা, মাছের আঁশ ছাড়ানো ও পরিষ্কারে ৮ টাকা, লবণ দুই টাকা এবং শুঁটকি বিক্রির সময় আড়তদারকে সাত টাকা দিতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতিকেজিতে আরও ২২ টাকা খরচ আসে। ১০০ কেজি কাঁচা মাছ কিনে শুঁটকি হয় ৩০ কেজি। সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০০-৬০০ টাকা লাভ থাকে। পুরো মৌসুমে ৫ হাজার কেজি শুঁটকি বিক্রি করি। এ বছর মাছ সংকট আছে। দামও বেশি। এতে লাভের পরিমাণও কম হবে। দেশীয় মাছ সংকট, ফাঁকা শুঁটকি পল্লীর অধিকাংশ চাতাল
বিজ্ঞাপন একই গ্রামের মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রায় ১২ বছর থেকে শুঁটকির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় দেশীয় মাছের সংকট যাচ্ছে। যেটুকু মাছ পাওয়া যাচ্ছে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এত দাম দিয়ে কিনে শুঁটকি তৈরি করে লাভ করা সম্ভব না। গত বছর পাঁচ হাজার কেজি শুঁটকি তৈরি করেছি। কিন্তু এ বছর ৩ হাজার কেজি শুঁটকি তৈরি করা কষ্টকর। তিনি আরও বলেন, পুঁটি মাছ প্রকার ভেদে ৬৫ টাকা থেকে ২২০ টাকা কেজি, খৈলসা ১৬০-১৭০ টাকা, টাকি মাছ ২৫০-৩০০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। শুঁটকি ব্যবসায়িদের দুর্দিন যাচ্ছে। উপজেলার জাত-আমরুল উত্তরপাড়া গ্রামের বয়জেষ্ঠ্য মৎস্যজীবী
সমজান আলী বলেন, বৃষ্টি কম হওয়ায় বন্যা নাই। জলাশয়গুলোতে পানি নাই বললেই চলে। মাছ শিকার করে আমাদের সংসার চলে। এখন নদ-নদীতে মাছ পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের সংসার চলাও কষ্টকর হয়ে উঠেছে। মৎসজীবীরা এখন কেউ কৃষি কাজ, কেউ ভ্যানচালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছর পর মৎস্যজীবী খুঁজে পাওয়া যাবে না। নদ-নদী ও জলাশয়গুলো খনন প্রয়োজন। যেখানে সারা বছর পানি জমে থাকবে এবং মাছ শিকার করা যাবে। বিজ্ঞাপন দেশীয় মাছ সংকট, ফাঁকা
শুঁটকি পল্লীর অধিকাংশ চাতাল শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল জব্বার বলেন, আমাদের স্বল্প পুঁজি। এ কারণে মাছ কিনে শুঁটকি তৈরি করেই বিক্রি করতে হয়। যদি কিছুদিন শুঁটকি ধরে রাখা যেত তাহলে ভালো দাম পেয়ে লাভবান হওয়া যেত। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে সুবিধা হতো। এছাড়া আমরা সরাসরি ভারতে শুঁটকি রপ্তানি করতে পারি না। কয়েকজন মহাজনের কাছে আমরা জিম্মি। তারা যে দাম রাখে সে দামেই শুঁটকি বিক্রি করতে বাধ্য। তারা রপ্তানি করে লাভবান হন। আর
আমাদের কষ্ট করা লাগে। আত্রাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, এ বছর প্রায় ১৪২ টন শুঁটকি উৎপাদনের সম্ভবনা আছে। যার গড় মূল্য হিসেবে দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ উপজেলার শুঁটকি ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক চাহিদা আছে। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সরাসরি সেখানে রপ্তানি করতে পারেন না। সৈয়দপুর, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাটের ব্যবসায়ীরা রপ্তানি করে থাকে। এ কারণে উপজেলার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা লাভের একটি অংশ থেকে বঞ্চিত হন। তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি তৈরিতে গত কয়েক বছর থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বদলগাছী কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার কেন্দ্রের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতিতে প্রভাব পড়েছে। বলতে গেলে শীত আরও আগে পড়ার কথা ছিল কিন্তু এখন পড়তে শুরু করেছে। যে সময় বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি, পরে হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক বছর থেকে সারাদেশেই এমনটা হয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় নদ-নদীগুলোতেও পানি কমেছে। তিনি আরও বলেন, বৈশিক জলবায়ুর প্রভাব এভাবে যদি চলতে থাকে আগামীতে কৃষিসহ অন্যক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে।