• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৫:০৩ অপরাহ্ন

রোজার বাড়তি চাহিদা সামলাচ্ছে দেশি ফল

অনলাইন ভার্সন
অনলাইন ভার্সন
আপডেটঃ : বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৪

এক সময় মৌসুম ছাড়া দেশে থাকতো না ফলের জোগান। মৌসুম নয়, এমন সময়ে রোজা হলে তখন নির্ভর করতে হতো বিদেশি ফলে। অর্থাৎ রমজানে ফলের বাড়তি চাহিদা পূরণ হতো আমদানির মাধ্যমে। তবে সময়ের পরিবর্তনে কৃষকরা এখন দেশি ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকেও ঝুঁকছেন। এবার রোজায় বাড়তি ফলের চাহিদা সামলাচ্ছে দেশি ফল।

আগে যেখানে শুধু ‘মধু মাসে’ (মে-জুন) বাজারে দেশি ফলের খোঁজ মিলতো, এখন সে চিত্র পাল্টেছে। বছরজুড়ে বাজারে নানান ফলের জোগান থাকছে। বিশেষ করে ২ দশক ধরে ফলের বাণিজ্যিক চাষের সাফল্যের কারণে দেশে ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে বলা যায়। এ কারণে এ বছর মৌসুম না হলেও ইফতারিতে আমদানি করা ফলের ওপর নির্ভরশীল ততটা হতে হয়নি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের আয় বাড়তে থাকলে খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে। আবার নগরায়ণের কারণেও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটছে। এখন মানুষের ফলমূল খাওয়া অনেক বেড়েছে। এ বছর রোজায় দেশে চাষ হওয়া আপেল, কমলা, আঙুর, মাল্টা, বেদানা, পেয়ারা, পেঁপে, বরই, আনারস, কলা, তরমুজসহ অন্যান্য ফল কেনার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এসব দেশি ফলের কারণে বিদেশি ফলের আমদানি কমেছে।

জাম, লিচু, বরই, কামরাঙ্গা, কদবেল, লেবু, আনারস, লটকন, আতা ও সফেদার মতো ফলগুলোও বেশি পরিমাণে চাষ করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। এমনকি ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ও মাল্টার মতো বিদেশি ফলের চাষও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে

কথা হয় রাজধানীর বাদামতলীতে খাজা ফ্রুট স্টোরের স্বত্বাধিকারী, আমদানিকারক ও পুরোনো ব্যবসায়ী বাইরাত মিয়ার সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সাউথ আফ্রিকার সবুজ আপেল আমরা আমদানিকারকরাই বিক্রি করছি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা কেজি। কাশ্মিরের পিয়ার বেচি ২৯০ থেকে ২৯৫ টাকা। ভারতীয় আঙুর আমাদানিতে খরচ ২৪০ টাকার ওপরে। এসব খুচরা বাজারে আরও ২০ থেকে ৫০ টাকা বেশি দামে ক্রেতারা কিনছেন।

তিনি বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করা ও ভ্যাট ট্যাক্স বাড়ার কারণে এবার ফলের আমদানিতে খরচ রেকর্ড পরিমাণ বেশি। সে তুলনায় দেশে উৎপাদিত ফলের দাম অনেক কম। সাশ্রয়ী ও জোগান বাড়ায় এখন দেশি ফলের কারবার বড় হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ এখন বার্ষিক কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া জাম, লিচু, বরই, কামরাঙ্গা, কদবেল, লেবু, আনারস, লটকন, আতা ও সফেদার মতো ফলগুলোও বেশি পরিমাণে চাষ করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। এমনকি ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ও মাল্টার মতো বিদেশি ফলের চাষও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

একদিকে বিদেশি ফলের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে দেশি ফলের ব্যাপক জোগানের কারণে উচ্চবিত্তরা ছাড়া এখন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ নির্ভর করছে দেশি ফলের ওপর।

রামপুরা বাজারে ফল কিনতে এসে ইউসুফ হোসেন বলেন, এখন আনারস, পেয়ারা, পেঁপে নিত্যদিনের ইফতারের সঙ্গী। এগুলোর দামও কম, খেয়েও তৃপ্তি। বাজারে এখন অহরহ ফল মিলছে, যা আগে এত ছিল না।

এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, এই রমজানে বিদেশি ফলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশি ফল কেনার প্রবণতা ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এসময় প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টনের মতো পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের দ্বিগুণ। এছাড়া পেঁপে ও আনারসের বিক্রি বেড়েছে ৩০ শতাংশ। দেশি সাগর ও সবরি কলার বিক্রিও অনেক বেড়েছে।

বিবিএস-এর খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২ এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত ছয় বছরের ব্যবধানে মানুষের প্রতিদিনের ফলমূল গ্রহণের পরিমাণ প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ২০১৬ সালের হিসাবে একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে ফলমূল গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৮০ গ্রাম।

ফল ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন বলেন, এ বছর আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙুরের মতো বিদেশি ফলের আমদানি কমেছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের সংকটে এলসি খোলা যায়নি। গত বছরের ১০২ টাকার ডলার, এখন ১২০ টাকা। আমদানি আরও কমবে এ অবস্থা থাকলে। এসময়ে মানুষের ভরসা হয়ে উঠছে দেশি ফল।

এদিকে তথ্য বলছে, গত কয়েক বছর ফলের আমদানি কমছে ক্রমাগত। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) দেশে বিদেশি ফল এসেছে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪ টন। এর আগের অর্থবছর (২০২১-২২) বিদেশি ফল আমদানি হয়েছিল ৮ লাখ ৯ হাজার ৭৯৬ টন। অর্থাৎ সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে ফল আমদানি কমেছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৭৫২ টন বা ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আমদানি করা ফলের মধ্যে শতাংশের হিসাবে সবচেয়ে কম এসেছে আপেল ও আঙুর। গত অর্থবছরে এই দুই ধরনের ফল আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৯ শতাংশ কম এসেছে। শুকনা ও তাজা কমলা কম এসেছে ২৫ শতাংশ। ম্যান্ডারিন (ছোট কমলা) কম এসেছে ১৬ শতাংশ। অন্য ফলের (মাল্টা, নাশপাতি, নাগ ফল, আনার ইত্যাদি) আমদানি কম হয়েছে ৩৭ শতাংশ।

এসব বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রাশেদুল হাসান বলেন, আমদানি কমলেও বাজারে ফলের জোগান কিন্তু কমছে না। দেশি ফল সে জায়গা করে নিচ্ছে। এখন সারা বছর ফলের জোগান যেমন বেড়েছে, তেমনি ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। আবার সারা বছর ফল চাষ করেও সবাই এখন অর্থনৈতিক সফলতার মুখ দেখছে। কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন দানাদার সফল চাষ বাদ দিয়ে ফল চাষে ঝুঁকছেন। এটা ভালো লক্ষণ। কারণ ফল বেশি অর্থকরী ফসল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ফলের প্রাপ্তি বাড়াতে সরকারের কিছু ভালো উদ্যোগ ছিল। সেটাও সুফল দিয়েছে। এখন বছরজুড়ে ফলের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে একটি প্রকল্প।

তিনি বলেন, এ কারণে ফল গ্রহণের মাত্রাও বেড়েছে। গত এক দশকে প্রায় তিনগুণ মাথাপিছু ফল গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে। সেজন্য সরকারের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ খুব ভালো কাজ করেছে।

এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত ছয় বছরের ব্যবধানে মানুষের প্রতিদিনের ফলমূল গ্রহণের পরিমাণ প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ২০১৬ সালের হিসাবে একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে ফলমূল গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৮০ গ্রাম।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক ও ফল বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদি মাসুদ বলেন, ড্রাগন ও পেয়ারা সারা বছর চাষ নিশ্চিত করা গেছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। সুফল এখন মিলছে। কাসাভা, স্ট্রবেরির মতো ফল বাগানিরা চাষ করছেন। বারোমাসি কাঁঠাল ও আম উৎপাদনের বাণিজ্যিক প্রারম্ভ হয়েছে।

তিনি বলেন, এ প্রকল্পের আরও একটি বড় সফলতা নওগাঁকে আমের রাজধানীতে রূপান্তর করা। সেখানে এখন সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হচ্ছে। রপ্তানিও হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। শুধু দেশের উৎপাদন নয়, রপ্তানিতেও এ প্রকল্প বড় সফলতা দেখিয়েছে।

মেহেদি মাসুদ বলেন, এ প্রকল্প শুরুর পর আমরা গড় ফল গ্রহণের মাত্রা ১০০ গ্রামে নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য এখন ২৫০ গ্রাম।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page