• শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৫৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম:
তথ্য সংগ্রহকালে সাংবাদিককে হুমকি ॥ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রাজউক কর্মকর্তার সিন্ডিকেট দুদকের জালে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচবিএম ইকবাল প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গেছেন শেখ হাসিনা: ড. ইউনূস ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে গুইমারা বাজারে সরকারি ড্রেন দখল করে প্লট নির্মান, নিরব প্রশাসন দাম কমালো জ্বালানি তেলের কোম্পানীগঞ্জে বন্যার পানির তীব্র চাপে ভেঙে গেলো মুছাপুর স্লুইসগেট মোংলায় মন্দির পাহারা ও সর্বসাধারণের নিরাপত্তায় কোস্ট গার্ড তাড়াশে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধন রামগড়ে ইউ.পি সদস্যের উপর সন্ত্রাসী হামলা, বিচার চেয়ে সংবাদ সম্মেলন চৌদ্দগ্রামে অবৈধ অস্ত্র সহ যুবক আটক!

রপ্তানি পরিসংখ্যানের গরমিলে ফেরত আসেনি ৭০০ কোটি ডলার

অনলাইন ভার্সন
অনলাইন ভার্সন
আপডেটঃ : শনিবার, ১ জুন, ২০২৪

দেশে ৯০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর টনক নড়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের রপ্তানি পরিসংখ্যানে এই গরমিল ধরা পড়ে। এতে দেখা যায়, নমুনা রপ্তানির ৭০০ কোটি ডলার দেশে ফেরত আসেনি। এ ছাড়া ২০০ কোটি ডলারকে টাকায় রূপান্তরের সময় তারতম্য ঘটে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটির তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গরমিল খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয় এই কমিটি গঠন করে। আগামী তিন মাসের মধ্যে তারা এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে পারবে বলে জানিয়েছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রপ্তানিসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কঠোর নজরদারির অভাবে রপ্তানি পরিসংখ্যানে এমন গরমিল হয়েছে।

দেখা গেছে, বিপুল অঙ্কের টাকা দেশে ফেরেনি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণে গরমিলের পেছনে ১৪টি বিষয় চিহ্নিত হয়েছে। এসব বিষয়ে তারা আরো অনুসন্ধান করবে। কমিটি জানায়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান পদ্ধতি, ইএক্সপি, কাস্টমস পরিসংখ্যান, বিল অব ল্যান্ডিং, কাটিং মেকিং টিমিং বা সিএমটি এবং এফওবি তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে আরো মাস তিনেক সময় লাগবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ইপিবি সূত্রে জানা গেছে।

রপ্তানিকারকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিধি অনুসারে নমুনা রপ্তানিতে বাণিজ্যিক মূল্য ধরা হলেও এটা বিনিময়যোগ্য নয়। এ ছাড়া ক্রেতাদের বিলম্বে মূল্য পরিশোধ, পণ্যে মূল্যহ্রাস ও স্থগিতসহ নানা কারণে রপ্তানি আয় দেশে না আসার কারণে হিসাবের এমন ব্যবধান তৈরি হতে পারে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এই গরমিলের বড় কারণ রপ্তানি করা পণ্যের একটি বড় অংশ দেশে আসে না। এ ছাড়া রপ্তানি প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত জটিলতা, প্রকৃত পরিসংখ্যান অন্তর্ভুক্তির সময়ের ব্যবধান—এসব কারণেও গরমিল হয়।

এ জন্য রপ্তানি পরিসংখ্যান রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো স্বচ্ছতা ও কঠোর নজরদারির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে পাঁচ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ড্যাশবোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, রপ্তানিকারকরা গত অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানির ঘোষণা (ইএক্সপি) দিয়েছেন চার হাজার ৬৩১ কোটি ডলারের। সে অনুযায়ী, দুই সংস্থার গত অর্থবছরের রপ্তানি তথ্যে ৯২৪ কোটি (৯.২৪ বিলিয়ন) ডলারের গরমিল দেখা যাচ্ছে।

রপ্তানি আয়ের বড় খাত তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি এম এম মান্নান কচি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নমুনা রপ্তানির নামে বিশাল অঙ্কের ব্যবধানের কথা বলা হলেও এ ব্যাপারে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যথাযথ তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি।’

তিনি বলেন, পণ্য রপ্তানি করার পর প্রতারকচক্র পণ্যের টাকা পাঠায় না। এ ছাড়া পণ্যের আদেশ স্থগিত, বিলম্বে বিল প্রদান, ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানির ফলে এমন তারতম্য হতে পারে। এ ছাড়া কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নমুনা রপ্তানিতে একটি বাণিজ্য মূল্য ধরলেও এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিধি অনুসারে বিনিময়যোগ্য নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবি সূত্রে জানা যায়, ইপিবির পরিসংখ্যানের সঙ্গে রপ্তানির হিসাব রাখে—এমন সংস্থাগুলোর হিসাবে এই তারতম্য তৈরি হয়। এই ব্যবধান খু্ঁজতে গিয়ে ১৪টি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে বিশাল অঙ্কের যে গরমিল পাওয়া যায়, তা হলো রপ্তানিকারকরা পণ্যের নমুনা পাঠানোর নামে প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের যে পণ্য পাঠিয়েছে, সেই আয়ের টাকা দেশে ফেরত আসেনি। এ ছাড়া টাকা ডলারে রূপান্তরের সময় প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের তফাত তৈরি হয়।

রপ্তানি তথ্যের এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে ‘রপ্তানি পরিসংখ্যানের গরমিল দূরীকরণ’ সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে ইপিবির রপ্তানি তথ্যের পার্থক্যের একাধিক কারণ থাকতে পারে। ইপিবি কাস্টম হাউসগুলোয় ইস্যুকৃত বিল অব এক্সপোর্টের ভিত্তিতে রপ্তানির তথ্য প্রস্তুত করে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তুত করে বিল অব লেডিংয়ের ভিত্তিতে। কাস্টমস থেকে কোনো বিল অব এক্সপোর্ট পরে বাতিল হলে সে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু এ তথ্য ইপিবির কাছে থাকে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক সিএমটির (কাটিং, মেকিং ও ট্রিমিং) ভিত্তিতে রপ্তানির ক্ষেত্রে কেবল মূল্য সংযোজনের পরিমাণকে রপ্তানি হিসেবে গণ্য করে। অন্যদিকে ইপিবি সম্পূর্ণ অর্থমূল্যকে (ইনভয়েস ভ্যালু) গণ্য করে।

গরমিলের পেছনে ১৪ বিষয়

১. বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূল্য পরিশোধ ভিত্তিতে রপ্তানি তথ্য সংকলন করে। কিন্তু ইপিবি এনবিআর ও কাস্টমসের অ্যাসাইকোডা ওয়ার্ল্ড থেকে অপরিপক্ব তথ্য সংকলন করে। এ সময় রপ্তানির সময় এবং পণ্য মূল্যের রপ্তানি সময়ের টাকা ও ডলারের দর ওঠানামার মধ্যে একটা বড় ব্যবধান তৈরি হয়।

২. পণ্য পুনঃ রপ্তানি করা হলে এনবিআর সেই পণ্যও রপ্তানি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু ইপিবির হিসাবে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

৩. উপহারসামগ্রী নমুনা রপ্তানি এনবিআরের তালিকায় দেখানো হয়, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে তা রপ্তানি নয়।

৪. বাংলাদেশ ব্যাংক শর্ট/এক্সেস শিপমেন্ট সমন্বয় করে। এনবিআর ও ইপিবি শর্ট/এক্সেস শিপমেন্ট সমন্বয় করে না। ৫. অনেক সময় যে পরিমাণ পণ্যের মূল্য রপ্তানি হয়, সেই পরিমাণ ডলার প্রত্যাবাসিত হয় না।

৬. এনবিআর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) থেকে কোনো পণ্য স্থানীয়ভাবে বিক্রয় হলে তাকে রপ্তানি হিসেবে গণ্য করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তা করে না।

৭. ইপিজেডের বাইরে রপ্তানিমুখী কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে কাঁচামাল বিক্রি হলে তা কাস্টমসের অ্যাসাইকোডাতে স্থানীয় রপ্তানি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তা থেকে পণ্য উৎপাদনের পর রপ্তানি হলে অ্যাসাইকোডাতে পুনঃ রপ্তানি হিসেবে ধরা হয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি ডাবল এন্ট্রি হয়।

৮. ইপিবি এনবিআরের অ্যাসাইকোডা থেকে রপ্তানি আয়ের যে তথ্য সংগ্রহ করে তা টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে মাসে শিপমেন্ট/অ্যাসেসমেন্ট হয়, ইপিবি সেই মাসের গড় ডলার মূল্য সংগ্রহ করে ওই টাকাকে ডলারে রূপান্তর করে রপ্তানি আয়ের হিসাব করে থাকে। অন্যদিকে এনবিআর কাস্টমস আইনের বিধান অনুযায়ী যে মাসে রপ্তানি অ্যাসেসমেন্ট হয়, তার আগের মাসের বৈদেশিক মুদ্রার গড় মূল্য ব্যবহার করে। এতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি তথ্যের মধ্যে তারতম্য হয়ে থাকে।

৯. রপ্তানিকৃত পণ্যের কিছু মূল্য অপ্রত্যাবাসিত থাকে, যার সুনির্দিষ্ট তথ্য ইপিবিতে নেই। কারণ এ তথ্য অ্যাসাইকোডাতে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই। তবে অপ্রত্যাবাসিত অর্থের হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারে।

১০. অপরিপক্ব তথ্যর মধ্যে একই ইএক্সপির বিপরীতে একাধিক বিল অব এক্সপোর্ট এন্ট্রি থাকে।

১১. একই ইনভয়েসের বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন এইচএস কোডে একই মূল্যমানের ভিন্ন ভিন্ন তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১২. বিল অব এক্সপোর্ট হওয়ার পর অনেক সময় পণ্য জাহাজীকরণ হয় না, যা এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব থেকে তা বাদ দেওয়া হয় না।

১৩. ক্রেতা অনেক সময় রপ্তানি পণ্যের সব কাঁচমাল উৎপাদনকারীদের সরবরাহ করে। বিক্রেতা শুধু পণ্য তৈরি করে ক্রেতাকে সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা শুধু সিএমটি সার্ভিস চার্জ হিসেবে মূল্য পায়। কিন্তু ইপিবি সম্পূর্ণ মূল্য দেখায়।

১৪. রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে সরবরাহ করা অপরিপক্ব তথ্যে পুরনো তথ্যও থাকে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ