ভারত–বাংলাদেশ টানাপোড়েনে ধস বারাণসীর শাড়ি ব্যবসায়
- আপডেট: ০৬:৫২:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫
- / ১০
মো. রাকিবুজ্জামান | বর্তমান কথা
ভারতের বারাণসীর ৫৫ বছর বয়সি বয়নশিল্পী মোহাম্মদ আহমদ আনসারি সারাজীবন কাটিয়েছেন বেনারসি শাড়ি বুনে। আজান ও ঘণ্টাধ্বনির শহর বারাণসীর সেই তাঁতের শব্দই ছিল তাঁর জীবনের সুর। কিন্তু এখন সেই সুর যেন ক্রমে থেমে যাচ্ছে—বিক্রি কমেছে অর্ধেকে, কাজ হারাচ্ছেন অসংখ্য তাঁতশিল্পী।
বারাণসীর ঐতিহ্যবাহী বেনারসি শাড়ির এই দুরবস্থার পেছনে বড় কারণ ভারত–বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাণিজ্য উত্তেজনা। গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। ঢাকা এখন দিল্লির কাছে হাসিনাকে ফেরত চায়, আর এই রাজনৈতিক সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাণিজ্যে।
এপ্রিলে বাংলাদেশ ভারতের কিছু পণ্যের আমদানি সীমিত করে, যার মধ্যে ছিল সুতা ও চাল। জবাবে ভারতও ১৭ মে থেকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাবার স্থলপথে আমদানি বন্ধ করে দেয়। এতে দুই দেশের মধ্যকার শাড়ি–বস্ত্র বাণিজ্যও গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন বাংলাদেশে শাড়ি রপ্তানি করতে হচ্ছে সাগরপথে, যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
ঐতিহ্যের শহরে ক্ষয়ের গল্প
বেনারসি শাড়ি বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত এর সূক্ষ্ম নকশা, বিলাসবহুল রেশম ও সোনালি–রুপালি জরি কাজের জন্য। একটি শাড়ি বুনতে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগে, আর দাম পড়ে লাখ টাকাও ছাড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানান আহমদ আনসারি।
তিনি বলেন, “আগে প্রতিদিন কারখানায় তাঁতের আওয়াজে প্রাণ ফিরে পেতাম। এখন অনেক তাঁত একেবারেই বন্ধ পড়ে আছে।”
বহু ধাক্কায় নুয়ে পড়া শিল্প
বারাণসীর তাঁতশিল্প আগেও বহু আঘাত সহ্য করেছে—নোটবন্দি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, করোনার প্রভাব এবং গুজরাটের সুরতের আধুনিক পাওয়ারলুমের প্রতিযোগিতা। এসবের ফলে এখন কারিগরের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে, যা প্রায় দুই লাখে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ী পবন যাদব বলেন, “আমরা প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার শাড়ি পাঠাতাম। এখন সব বন্ধ। ওখানকার ক্লায়েন্টরা ১৫ লাখ টাকার দেনা শোধ করতে পারছেন না।”
পশ্চিমবঙ্গে ভিন্ন চিত্র
তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তাঁতশিল্পীরা বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা তাঁদের জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ। নদিয়ার শান্তিপুরের তাঁত ব্যবসায়ী তারকনাথ দাস বলেন, “বাংলাদেশি শাড়ি আমাদের বাজারের ৩০ শতাংশ দখল করেছিল। এখন আবার অর্ডার বাড়ছে। দুর্গাপূজায় বিক্রি গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে।”
বেনারসি। ছবি: আল-জাজিরা
অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক যতদিন উত্তেজনাপূর্ণ থাকবে, ততদিন বারাণসীর বয়নশিল্পীরা সংকটে থাকবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের তাঁতীরা সাময়িক স্বস্তি পেলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে এই টানাপোড়েন দুই দেশের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রশিল্পকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
রাজনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে, শতাব্দীপ্রাচীন এই বেনারসি শাড়ির জগৎ হয়তো আরও কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে।
| সূত্র: আল-জাজিরা