‘আমরা শুধু বাঁচতে চাই’, গাজার শিশুদের আকুতি
- আপডেট: ০৭:৩৯:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫
- / ৭৫
গাজার পশ্চিমাঞ্চলের বিধ্বস্ত তেল আল-হাওয়া পাড়ায়, একটি ছেঁড়া তাঁবুর নিচে বসে আছে ১৪ বছরের কামাল মাহদি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এক সময়ের ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকায় এখন শুধু স্মৃতি আর শূন্যতা। তার কুঁজো শরীর, বিস্ফারিত চোখ আর ফিসফিস কণ্ঠে বলে—গাজার শিশুদের জীবনে কীভাবে এক সময়ের স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে।
“যুদ্ধের আগে জীবনটা ছিল খুব সাধারণ,” বলে কামাল। স্কুলের ইউনিফর্ম পরে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলা আর দাদার গল্প শোনার সেই দিনগুলো এখন তার কাছে遥远 স্মৃতি। এখন তার বাস্তবতা হলো একের পর এক পালিয়ে বেড়ানো, হারিয়ে ফেলা দাদার কবর, ছেঁড়া খাতা আর স্মৃতির টুকরো।
তার পাশে বসে থাকা চাচাতো বোন ক্যামেলিয়া, বয়স মাত্র ১২, শক্ত করে চেপে ধরা পুরোনো স্কুলব্যাগের মতোই আঁকড়ে রেখেছে তার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলো। “আমি স্কুল ভালোবাসতাম,” বলে সে। শিক্ষক হতে চাওয়া মেয়েটি আজ প্রতিটি বাতাসের শব্দে কেঁপে ওঠে, বোমার ভয় তাকে লুকিয়ে রাখে, অথচ কোথাও নেই নিরাপদ আশ্রয়।
কামালের একটি বাক্যে যেন পুরো প্রজন্মের গল্প বলা হয়ে যায়—
“এই যুদ্ধ আমাদের শিশু থেকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে।
“২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজা শহর শুধু পরিণত হয়নি ধ্বংসস্তূপে, বরং শিশুদের স্বাভাবিক জীবনও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘাতে ইতোমধ্যেই ১৬,৫০০-এর বেশি শিশু প্রাণ হারিয়েছে। অসংখ্য শিশু হারিয়েছে হাত-পা, কেউ দগ্ধ, কেউবা চরম মানসিক বিপর্যয়ে ভুগছে। নয় বছর বয়সি ঈসা আহমেদ, তারই একটি প্রতীক। শরণার্থী শিবিরে একটি তাঁবুতে বাস করা এই শিশুটি এক বোমা হামলায় হারিয়েছে দুটো হাত। এখন সে শুধু স্বপ্নে দেখে, তার হাত ফিরেছে, সে মায়ের কাছে দৌড়ে যাচ্ছে। বাস্তবে, নিজের চোখের পানিও মুছতে পারে না সে।
তার মা সারা বলেন, “সে জিজ্ঞেস করে—তার হাত কি গজাবে? আমি কী বলব বুঝি না, শুধু বলি—তুমি সাহসী।” একই হামলায় স্বামীকেও হারিয়েছেন তিনি। এখন ঈসা ও তার ভাইবোনদের একাই লালন-পালন করছেন। অন্যদিকে ১০ বছর বয়সি লুজাইন শেহাদা প্রতিদিন লাইনে দাঁড়ায় পানির জন্য। ঘুমায় মাটিতে। তার ভাষায়, “আমার বিছানা আর স্কুলটাকে খুব মিস করি।” এই একটি বাক্যই বলে দেয়—এই শিশুরা ঠিক কী হারিয়েছে। গাজায় এখন ৯৫% এর বেশি স্কুল বন্ধ। বিকল্প কিছু পাঠদানের ব্যবস্থা থাকলেও নিরাপত্তাহীনতা, বিদ্যুৎ সংকট ও মানসিক বিপর্যয়ের কারণে বেশিরভাগ শিশু পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ছে।
ফিলিস্তিনের শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ বারহাম বলেন, “এই শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে। খাবারের মতোই তাদের মানসিক সেবাও এখন জরুরি।”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রাওয়ান গায়াদার বলেন, “গাজার শিশুদের ট্রমা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনেকেই PTSD-তে ভুগছে, কেউ কেউ নিজের নাম হাতে লিখে রাখছে—যদি মরতে হয়, পরিচয় যেন হারিয়ে না যায়।”
এই রিপোর্ট কেবল কিছু নাম, বয়স বা ঘটনা নয়। এটি একটি প্রজন্মের হারিয়ে যাওয়ার দলিল। কামাল, ক্যামেলিয়া, ঈসা কিংবা লুজাইন—তারা কেবল খেলতে চেয়েছিল, শিখতে চেয়েছিল, স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিল।
কিন্তু আজ তারা শুধু বাঁচতে চায়।
“আমাদের চাওয়া খুব বেশি নয়,” কামালের শেষ কথাটা যেন পৃথিবীর প্রতি এক শেষ আর্তি—“শুধু শান্তি চাই। শুধু বাঁচতে চাই।”