নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন আমিনুল হক ওরফে দুলাল। এই পেশার আড়ালে অনলাইনে শুরু করেন জাল নোটের কারবার। বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে তার অন্য সহযোগীদের নিয়ে কম সময়ে অল্প পুঁজিতে বেশি লাভের আশায় জাল নোট তৈরি ও সরবরাহের একটি চক্র গড়ে তোলেন।
ওজাল নোট তৈরির সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করেন আমিনুল। ডিজাইনে দক্ষতা থাকায় জাল নোট ডিজাইন এবং তা প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে প্রায় এক বছর যাবৎ চক্রটি পরিচালনা করে আসছিলেন আমিনুল।
জাল নোট তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা মোহাম্মাদ আমিনুল হক ওরফে দুলালসহ চক্রের চার সদস্যকে রাজধানীর ডেমরা, খিলগাঁও ও সবুজবাগ থেকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র্যাব। এসময় তাদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার মূল্যমানের জাল নোট উব্দ করা হয়।
র্যাব বলছে, গত এক বছরে দুই কোটি টাকার জাল নোট বাজারে ছেড়েছে চক্রটি।
গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন, আব্দুর রাজ্জাক ওরফে দিদার (৩০), মো. সুজন আলী (৪০) ও মোহাম্মদ সাকিবুল হাসান (২১)।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তাররা পরস্পর যোগসাজশে প্রায় এক বছর যাবৎ জাল নোট তৈরি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতারণার মাধ্যমে জাল নোট বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে আসছে।
গ্রেপ্তাররা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপ থেকে জাল নোট তৈরি ও ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি গ্রুপের মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে আমিনুলের পরিচয় হয়।
আমিনুলের নেতৃত্বে কম সময়ে অল্প পুঁজিতে বেশি লাভের আশায় তারা জাল নোটের ব্যবসা করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে এবং সেখানে তারা জাল নোট তৈরি/ব্যবসার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান করে। এই মেসেঞ্জার গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে কাজ করত দিদার।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, গ্রেপ্তার আমিনুল জাল নোট তৈরির সার্বিক বিষয়ে দক্ষ হওয়ায় নিজেই ল্যাপটপ, প্রিন্টার, পেনড্রাইভ, কাগজ, টিস্যু পেপার ও প্রিন্টারের কালিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয় করেন। গ্রেপ্তার আমিনুল জাল নোট প্রিন্টিং করে গ্রেপ্তার দিদারকে দিতেন এবং গ্রেপ্তার দিদার চক্রের অপর সদস্য গ্রেপ্তার সুজনকে সঙ্গে নিয়ে জাল নোট কাটিং ও বান্ডিল করতেন।
কমান্ডার মঈন বলেন, যখন জাল নোটের ব্যবসা রমরমা থাকে তখন চক্রটি দৈনিক দুই-তিন লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট তৈরি করত বলে জানা যায়।
মূলত তারা একটি অভিনব কায়দায় জাল নোটগুলো বিক্রি করত। তারা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে জাল নোট নিতে আগ্রহীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলত। পরে অগ্রিম টাকা নিয়ে নিত এবং পরবর্তী সময়ে তাদের সুবিধাজনক স্থানে জাল নোটগুলো সরবরাহ করত।
চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করা জাল নোট সরবরাহ করা হতো। তারা প্রতি এক লাখ টাকা মূল্যের জাল নোট ২০-২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করত। চক্রটি মাছ বাজার, লঞ্চ ঘাট ও বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন মার্কেটে নানান কৌশল অবলম্বন করে জাল নোট সরবরাহ করত বলে জানা যায়।
এছাড়া তারা বিভিন্ন মেলা, উৎসব, পূজা ও কোরবানির পশুর হাটে জাল টাকা ছড়িতে দিতে বিপুল পরিমণে জাল নোট ছাপাতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে জাল নোট প্রিন্টিংয়ের সময় কাগজের অব্যবহৃত ও নষ্ট অংশগুলো পুড়িয়ে ফেলা হতো। এ পর্যন্ত চক্রটি বিভিন্ন সময়ে প্রায় দুই কোটি মূল্যমানের জাল নোটের ব্যবসা করেছে বলে জানা যায়।
গ্রেপ্তার আব্দুর রাজ্জাক ওরফে দিদার হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে নিজস্ব গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে গার্মেন্টস ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতিতে পড়ায় সে স্বল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘জাল নোট বিক্রি করি, জাল টাকা সেল, জাল টাকা বেচি’সহ বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে যুক্ত হয়। সে চক্রের মূলহোতা আমিনুলের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করত। পাশাপাশি জাল নোটগুলো প্রিন্ট করার পর আমিনুলের কাছ থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো কাটিং ও বান্ডেল করত। পরে মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে নির্বাচিত বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের কাছে সরবরাহ করত।
গ্রেপ্তার সুজন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে এলাকায় একটি জুতোর দোকান পরিচালনা করত। সে ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ঋণগ্রস্ত হওয়ায় ঢাকায় চলে আসে। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাল নোট তৈরি চক্রের আমিনুল ও দিদারের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে চক্রের মূলহোতা আমিনুলের সহযোগী হিসেবে কাজ করত। দিদারের সঙ্গে জাল নোটগুলো প্রিন্ট করার পর সেগুলো সংগ্রহ করে কাটিং এবং বান্ডেলের পর মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের কাছে সরবরাহ করত।
গ্রেপ্তার সাকিবুল রাজধানীর একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করত। পাশাপাশি সে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখত। এছাড়া আমিনুলকে প্রিন্টিংসহ সব কাজেই সে সহযোগিতা কর।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন জানান, তারা জালনোটগুলো তৈরি করার পর ১০ থেকে ১৫ দিন রেখে দিত; এতে করে মানুষ বুঝতে না পারত না এগুলো জাল টাকা। তবে কোনো একপর্যায়ে কারো না কারো কাছে ধরা পড়ে যায় এসব জাল নোট।