বিভিন্ন সময়ে পরিবহন ধর্মঘট হয়, সে সময় রাস্তায় কোনো গাড়ি চলাচল করে না। আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের তখন অনেক দুর্ভোগে পড়তে হয়। কিন্তু বিআরটিসির গাড়ি থাকায় সেই দুর্ভোগ অনেকটাই কেটে যায়। মিরপুর থেকে নিশ্চিন্তে বাসে উঠে শাহবাগ গিয়ে নামি। ক্লাস শেষে আবার চলে আসি। এভাবেই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত রসায়নবিদ্যার শিক্ষার্থী তানজিদ হাসান। যেখানে সরকারি সেবা নিয়ে নানা অভিযোগ, সেখানে কিছুটা হলেও তিনি ভরসা রাখছেন সরকারি পরিবহনসেবা প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির গাড়ির ওপর।
একই অভিমত জানান মতিঝিলে একটি বেসরকারি সার্ভে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাফিসা আঞ্জুম। বলেন, অনেক সময় অফিসে কাজের চাপ থাকলে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। একজন নারী হিসেবে সে সময় অন্যান্য পরিবহনের তুলনায় বিআরটিসিকেই বেশি নিরাপদ মনে করি।
শুধু নাফিসা বা তানজিদ নন, তাদের মতো অনেকেই রয়েছেন যারা বিআরটিসির বাসেই আস্থা রাখছেন। অবশ্য এ আস্থা ফেরাতে প্রতিষ্ঠানটিকেও যথেষ্ট সংস্কারকাজ করতে হয়েছে। বিআরটিসির প্রতিটি বাসেই পাশাপাশি দুই সিটেও রয়েছে যথেষ্ট ফাঁকা। ফলে বসার সময় কাউকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না। প্রতিটি সিটের পাশেই রয়েছে ইলেকট্রিক ফ্যান। ভাড়া নিয়েও এখন আর দর-কষাকষি করতে হয় না। গন্তব্যের কথা জানালেই পোজ মেশিনের মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কাটা হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক গাড়িতেই বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা ও ভেহিক্যাল ট্রাকিং সিস্টেম (ভিটিএস)। ফলে একটি গাড়ি কখন কোথায় আছে তা যেমন জানা যায়, তেমনি বাসটির বর্তমান পরিস্থিতি কী তাও সিসি ক্যামেরায় দেখা যায়।
অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত ছিল না সাধারণ মানুষের। বাসের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমে যাওয়া, ফ্যান-লাইট নষ্ট, সিট ভাঙা, ভাড়া নিয়ে তর্ক সাধারণ যাত্রীদের এমন অভিযোগের পাশাপাশি ডিপো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পেট্রলপাম্প থেকে কমিশন বাণিজ্য, বাসের ট্রিপ চুরি, খাতায় রাজস্ব আয় কম দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, বিআরটিসি টার্মিনালের সরকারি জায়গা ভাড়া দেওয়া, স্থায়ী চালক থাকা সত্ত্বেও ক্যাজুয়াল লোক দিয়ে গাড়ি চালানো, বাস মেরামতের নামে টাকা লুটপাট, অতিরিক্ত জনবল দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছিল। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ তদন্তেও এসব ঘটনার সত্যতা পাওয়া গিয়েছিল।সে সময় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছিল যন্ত্রাংশ কেনার নামে অতিরিক্ত ব্যয় ও নিজেদের পকেট ভারী করছেন কয়েকজন অসাধু ডিপো ম্যানেজার ও তাদের সিন্ডিকেট। ডিপোয় যানবাহন মেরামত ব্যয়, গাড়িতে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার, গাড়িচালকদের আয় থেকে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ চাঁদা বা চুঙ্গি আদায়, চাঁদা না দিলে অন্যত্র বদলি করাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করতেন এসব কর্মকর্তা।কিন্তু দুই বছরেই যেন আমূল পরিবর্তন ঘটে এই প্রতিষ্ঠানটিতে। একসময় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থছাড়ের আশায় বসে থাকা প্রতিষ্ঠানটি এখন স্বনির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় বকেয়া দাবিতে আন্দোলন ছিল বিআরটিসির সাধারণ ঘটনা। আন্দোলন করতে গিয়ে কর্মকর্তাদের হাতে নাজেহাল হয়ে অনেকে চাকরিও হারিয়েছেন। কিন্তু এখন মাসের ১ তারিখের মধ্যেই ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন চালক-শ্রমিকরা। তাদের বকেয়া পাওনা শতকোটি টাকার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ইতোমধ্যেই পরিশোধ করা হয়েছে নিজস্ব তহবিল থেকে। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, যেখানে প্রতি তিন বছর পরপর একজন শ্রমিক ১৫ দিনের ছুটিসহ পূর্ণ এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ ভাতা পেয়ে থাকেন।একটা সাগরের মইদ্দে থেইক্যা বিআরটিসিকে স্যার বাঁচাইলেন। সাগরের মধ্যে হাবুডুবু করছে সেইহেন থেইকা তুলে ধরছেন, এইটা ভাষায় প্রকাশ কইরবেন্নায় এভাবেই অশ্রুসিক্ত চোখে কথাগুলো বলছিলেন কল্যাণপুর বাস ডিপোর চালক (বি) গোলাম হোসেন। আগামী এপ্রিল মাসে মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। হাতে টাকা নেই কিন্তু ভরসা আছে কর্মস্থলের ওপর, বিশেষ করে বর্তমান চেয়ারম্যানের ওপর। শুধু সরকারি অর্থায়নের ওপর নির্ভরতা বাদ দিয়ে মাত্র দুই বছরের মাথায় ডুবন্ত প্রতিষ্ঠানকে স্বনির্ভর করে তুলেছেন, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করছেন, এমনকি অসহায় ও পঙ্গুত্ববরণ করা শ্রমিকদের বাড়ি গিয়ে যে মানুষটি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তার কাছে গেলে একটা উপায় হবেই। এভাবেই শুধু গোলাম হোসেনই নয়, বিআরটিসির সব শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ।
এদিকে নতুন নেতৃত্ব পেয়ে বিআরটিসিও যেন ফিরে পেয়েছে কর্মউদ্দীপনা। নতুন নতুন সেবা ও গাড়ি যুক্ত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির বহরে। এ ছাড়া যে মেরামত কারখানাগুলো একসময় অচল পয়ে পড়েছিল সেগুলোতে এখন পুরোদমে গাড়ি মেরামত ও সংস্কারের কাজ চলছে। প্রতি মাসেই ২০ থেকে ২২টি নতুন গাড়ি বের হচ্ছে এসব মেরামত কারখানা থেকে। আবার নিজস্ব পরিবহনের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি মেরামতের মাধ্যমে অর্থ আয় করা হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ ধরনের অন্যান্য গাড়ি মেরামত হয়েছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি। ১২০০ বাসে বসানো হয়েছে ভিটিএস প্রযুক্তি, ১৯১টি বাসে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা এবং ৫০টি বাসে সিসি ক্যামেরা।
বিগত সময়ের নানা সমস্যা ও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তা থেকে আমূল পরিবর্তনের এ বিষয়টি নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি জানান, কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়ে যদি পরিচালকদের শতভাগ ধ্যান-জ্ঞান থাকে এবং তারা যদি চায় স্বচ্ছতার মাধ্যমে পরিচালিত হয় তাহলে আমি মনে করি বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠানই মানুষকে যথাযথ সেবা দিয়ে মুনাফা অর্জন করতে পারবে।