পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংবিধানিক শাসন চালুর বিকল্প নেই, প্রয়োজনে হরতাল অবরোধ কর্মসূচী পালন করা হবে। পিসিএনপি'র গোল টেবিল আলোচনায় বক্তারা এই হুশিয়ারী দেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংবিধানিক শাসন চালু করার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন চলবে। প্রয়োজনে অবরোধ কর্মসূচী পালন করবে পাহাড়ে সমাধিকার আন্দোলনকারী সংগঠন পিসিএনপি। ১৩ জুলাই গোল টেবিল আলোচনায় পাহাড়ি তিন জেলার নেতৃবৃন্দরা এই ঘোষনা দিয়েছেন।
উপনিবেশিক ও অসাংবিধানিক ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি আইন বহাল রাখার ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে আশু করণীয় শীর্ষক 'গোলটেবিল আলোচনা' অনুষ্টিত হয় নগরীর এশিয়ান এস আর হোটেলের কনভেনশন হলরুমে। সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক মাননীয় সংসদ সদস্য, কক্সবাজার-১। জেনারেল ইব্রাহীম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির মালিক সেখানে বসবাসরত পাহাড়ি, বাঙালি ও সরকার। সরকার চাইলে ক্যাডেস্টাল সার্ভে করে এর সমাধান করতে পারেন। বিগত শতকের ৮৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে জেনারেল এরশাদ সরকার এতদবিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ভূমি জরিপের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। সে সময় জেএসএস এর বিরোধিতা করেন ও এরশাদ সরকারের সময় পুরিয়ে যাওয়া সেটি করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মোঃ মজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে
গোল টেবিল আলোচনায় অন্যান্য আলোচকরা হলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনুস,আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম এর অধ্যাপক, ড. আ.ফ.ম খালিদ হোসাইন, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, খাগড়াছড়ি পৌরসভা সাবেক মেয়র ও, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উপদেষ্টা সাবেক মেয়র মোঃ রফিকুল ইসলাম প্রমূখ। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এর মহাসচিব মো: আলমগীর কবির এর সঞ্চালনায় আলোনায় প্রবন্ধ পাঠ করেন এ্যাডভোকেট এম.এ.কে পারভেজ তালুকদার। বক্তারা
বলেন, সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কোনো ভান-ভণিতা, ঘোর-প্যাঁচের আশ্রয় না নিয়ে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যা স্পষ্ট করে বলেছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিস্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে একটি স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নতুন নয়, বহু পুরনো। সত্তরের দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পাহাড়ে শান্তি বাহিনীর যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে মদদ দিয়েছিল অনেক বিদেশি রাষ্ট্র। তথাকথিত মানবাধিকার এবং উপজাতীয়দের অধিকার সুরক্ষার কথা বলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল ওই সব রাষ্ট্র। পাহাড়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্যান্য সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ন্যায় নতুন করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) যে সহিংসতা শুরু করেছে তার পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এর অন্যতম কারণ হলো- বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ডতুল্য খনিজ সম্পদের অপার সম্ভাবনাময় এক-দশমাংশ অঞ্চল তথা পার্বত্য এলাকাকে নিয়ে খ্রিস্টান রাষ্ট্র তৈরির পরিকল্পনা করছে পশ্চিমারা। বিশ্লেষকদের মতে, শুধু বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল নয়, ভারতের নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরামকে একত্র করে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। এছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও মিয়ানমারের কিছু অঞ্চল নিয়ে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের সংশোধিত পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এই অঞ্চলে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই বিদেশি রাষ্ট্রের মদদে কেএনএফ নতুন করে সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে। খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই পাহাড়ে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শাসনামলে মিশনারিরা ভিনদেশি সংস্কৃতির বিকাশ ও ধর্মান্তরের যে প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেন, পর্যায়ক্রমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে তার ক্রমবিকাশ অব্যাহত থাকে। স্কুল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, হাসপাতাল স্থাপন, ঋণ প্রদান, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, দারিদ্রদ্র্য বিমোচন, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি জনপ্রিয় কর্মসূচির আড়ালে রয়েছে এ দেশে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার ও পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রসারের নীল নকশার বাস্তবায়ন।
পাহাড়ি যেসব জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, তাদের প্রায় শতভাগ খ্রিস্টান হয়ে গেছে অনেক আগেই। পাহাড়িদের পৃথক সত্তা ও নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা নিশ্চিত করতে দেশে-বিদেশে ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা প্রচার করা হচ্ছে। পাহাড়িদের নিজস্ব সংস্কৃতি অটুট রাখার জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনকারী পশ্চিমা গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে চলা ধর্মান্তরিতকরণ সেখানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে উপজাতীয়দের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ আজ আক্ষরিক অর্থেই বিপন্ন। তাদের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এরই মধ্যে ত্রিপুরা, বম, স্রো, পাংখোয়া উপজাতি পুরোপুরি খ্রিস্টান হয়ে গেছে; বদলে গেছে তাদের ভাষা; এমনকি তাদের ভাষার হরফও ইংরেজি বর্ণমালায় রূপান্তর করা হয়েছে। এনজিও নাম ধারণ করে কয়েকটি খ্রিস্টান মিশনারি এই দুর্গম এলাকায় হাসপাতাল, বিনোদনকেন্দ্র, চার্চ ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। ইতিমধ্যে অনেক উপজাতীয় সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব আদি ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছে। যেসব কারণে পশ্চিমারা খ্রিস্টান মিশনারি ও এনজিওগুলোকে ব্যবহার করে একটি আশ্রিত খ্রিস্টান রাষ্ট্র তৈরি করতে চায় তার মধ্যে অন্যতম হলো: ১. ভূ-রাজনীতি, ভূ-অর্থনীতি ও ভূ-কৌশলগত কারণে এই অঞ্চল পশ্চিমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টান রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রতিরক্ষাবলয় সৃষ্টি করতে চায়।
২. ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মিলনস্থলের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরের এমন এক স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান যার পাশ দিয়েই রয়েছে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের চ্যানেল। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় দারুণ সম্ভাবনাময় ভূ-কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশের। এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য সেন্ট মার্টিন কিংবা হাতিয়া কিংবা বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের কিছু অঞ্চল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনকে কোণঠাসা করতে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী গোষ্ঠীকে সহায়তার লক্ষ্যে সম্প্রতি 'বার্মা অ্যাক্ট' প্রণয়ন করেছে।
৩. যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য কমাতে তৎপর। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়াকে সাদা মনে গ্রহণ করেনি পশ্চিমারা। তাই ইন্দো-প্যাসিফিক জোট করে বাংলাদেশকে সেই জোটে যুক্ত করতে চাইছে পশ্চিমারা। 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়'-এই পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশ কোনো সামরিক জোটে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করে আসছে। বড় শক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে খুঁটি হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলে একটি অনুগত খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পশ্চিমাদের জন্য তাই অতি গুরুত্ববাহী। ভূ-রাজনীতির এমন এক সমীকরণে নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
৪. ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত, পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য কমাতে চীন-রাশিয়া-ইরানের নেতৃত্বে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার উকিঝুঁকি ও চীন-তাইওয়ান উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের চোখ-রাঙানি লক্ষণীয়। এ অবস্থায় এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাদের জন্য অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার।
খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পশ্চিমাদের পরিকল্পনা হলো পার্বত্য অঞ্চলে ধর্মান্তরিত উপজাতীয়দের সংখ্যা পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে তাদের দিয়ে গণভোটের দাবি তোলা হবে। পশ্চিমারা তখন জাতিসংঘে গণভোটের পক্ষে জোরালো চাপ সৃষ্টি করবে। এভাবে প্রতিষ্ঠা করবে তাদের স্বপ্নের স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র। মিশনারি ও এনজিওগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলো মূলত মানুষ ধরার ফাঁদ ও ষড়যন্ত্রের নীল কুঠি। পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া পাহাড়িদের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি যারা ঘটাচ্ছে তারা যদি পাহাড়িদের রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের শিকড় কেটে দিতে সক্ষম হয়, তবে তা বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠবে। খ্রিস্টান মিশনারি, পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠী ও এনজিওচক্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে টার্গেট করে সামনে এগোচ্ছে। পরিস্থিতি এভাবে অব্যাহত থাকলে গোটা পার্বত্য অঞ্চল রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। সাম্প্রতিক আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ এ কথারই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে দক্ষিণ সুদান ও ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরের মতো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জোর তৎপরতা এগিয়ে চলেছে। সুতরাং রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সকল স্বরযন্ত্র রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের আহবান জানাই। তার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০ সাল সম্পূর্ন বাতিল করতে হবে। বক্তারা আরো বলেন, পাহাড়ে সাংবিধানিক শাসন চালুর আন্দোলনে সকল পেশার মানুষ, বিশেষ করে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালের ছাত্ররা আন্দোলন করতে হবে।