সাঈদুর রহমান রিমন।
বৈধ আয়ের পথ ছাড়াই রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া কয়েক হাজার মানুষ দেশের বড় আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারাই গড়ে তুলেছে লুটপাটের সাম্রাজ্য। দেশের ভরাডুবি ঘটিয়ে বিদেশে টাকা পাচার, ইউরোপ-আমেরিকায় সেকেন্ড হোম, থার্ড হোম বানানোসহ বড় বড় ব্যবসা বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে। তাদের বেপরোয়া কর্মকান্ড দেশ ও সমাজের সর্বস্তরে অসম পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, ঘটাচ্ছে সীমাহীন বিশৃঙ্খলা। সমাজে কোন্দল-সংঘাত, জবর দখলদারিত্ব, একচ্ছত্র আধিপত্যের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাসহ লাগামহীন অপরাধ অপকর্মের নেতৃত্বও দিচ্ছে তারা।
হঠাৎ বড়লোকদের একটি বড় অংশই দলীয় নানা পর্যায়ের নেতৃত্ব দখল করছে, ছিনিয়ে নিচ্ছে জনপ্রতিনিধির চেয়ারও। ফলে সর্বত্রই শাসন শোষণের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদকে রাতারাতি কয়েক গুণ বৃদ্ধি করার দুর্ণিবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ প্রতিযোগিতার বিপরীতে অপরাধ-অপকর্ম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদবিরবাজি থেকে শুরু করে সব ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে বাধাহীনভাবে।
অর্থবিত্তের বেপরোয়া দাপটে সর্বত্রই নীতি নৈতিকতা জলাঞ্জলী দিয়ে একে অপরকে টপকে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। গত বছরেই নতুন কোটিপতি হয়েছেন ৩০ হাজার ব্যক্তি। তাদের অধিকাংশের বৈধ আয়ের কোনো উৎস নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বা কর ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক হিসেবেও এসব কোটিপতির নাম তালিকা ছিল না। এমনকি ব্যাংকিং একাউন্টের হিসেব কষে তাদেরকে চিহ্নিত করার উপায় নেই। এদের মধ্যে চার সহস্রাধিক কোটিপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে দুর্নীতি-লুটপাট সংক্রান্ত অভিযোগ রয়েছে- তবে সেসব অভিযোগ কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়নি। ফলে সহসা তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ নেই।
হঠাৎ ক্রোড়পতি হয়ে ওঠা লোকগুলোই সমাজ ও রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আপদ। উৎসহীন বেশুমার টাকার গরমে তারা সমাজ, দল ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে নানা বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জানান দেয়। সর্বত্রই প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তোলে, অসম লড়াই বাধিয়ে নিজের বাহাদুরী প্রমাণ করে। পাহাড়সম অর্থবিত্তের দাপটেই আপদ মার্কা লোকগুলো সমাজের কর্তৃত্ব কিনে নেয়, টাকা ছিটিয়েই দখল করে দলীয় পদ-পদবীও। রাতারাতি তারা এমপি, মন্ত্রী এমনকি আরো আরো প্রতাপশালী মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ফলে সবকিছুকেই তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতা দেখাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। হঠাৎ দাপুটে হয়ে ওঠা লোকগুলো সব অসম্ভবকেই সম্ভবে পরিনত করার মধ্য দিয়ে বিকৃত আনন্দবোধ করে।
নানা তথ্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, দেশে হঠাৎ বড়লোক বা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার বৈধ কোনো উপায় নেই। ‘যদি লাইগ্যা যায় মার্কার লটারী‘ ব্যবস্থাও সচল নেই। আছে-রাতারাতি অলৌকিক কায়দায় আলাদীনের মতো আশ্চর্য জাদুর প্রদীপ লাভ করা, ‘ম্যাগনেটিক পিলার’ কিংবা তক্ষক লেনদেনের বাণিজ্য, ঠিকাদারী ব্যবসা চালানো, ইয়াবা বাণিজ্যে অংশগ্রহণ আর তাদের সবচেয়ে সেরা পথ হচ্ছে তদবিরবাজীর দাপুটে বাণিজ্য।
যে পথে হঠাৎ ক্রোড়পতি
অলৌকিকতার বাইরে রাতারাতি অগাধ টাকার মালিক হওয়ার সার্বজনীন পথ হলো 'ঠিকাদারী বাণিজ্য।‘ ক্ষমতাসীন দলের সুগন্ধী দেহে লাগিয়ে, নানা ধূর্ততা, কুটকৌশল আর বহুমুখী প্রতারণাকে পুঁজি করে ঠিকাদারীর সাইনবোর্ডে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়া হচ্ছে। ঠিকাদাররা সরকারের নানা সেক্টরে কাজ করলেও স্বাধীন ব্যবসায়ি, তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো জবাবদিহিতাও নেই। দুই-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারের সিংহভাগ কাজই ঠিকাদাররা যেমন খুশি তেমন ভাবেই করতে পারেন, ফলে লুটপাটও চলে যথেচ্ছা। ঠিকাদারি কর্মকান্ডে নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী, রডের পরিবর্তে বাঁশ-কঞ্চির ব্যবহারসহ টেন্ডারের শর্ত ভঙ্গ, কাজ না করেই কোটি কোটি টাকা তুলে নেয়ার মতো হরিলুটের ঘটনা এখন অলিখিত নিয়মে পরিনত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা লুটপাট সহযোগিতায় বরাবরই তৎপর থাকেন। একটু চোখ মেলে তাকালেই হঠাৎ ফুলে ফেপে প্রতাপশালী হওয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, জি.কে শামীম থেকে শুরু করে শাহেদ করিম পর্যন্ত অজ্ঞাত ক্ষমতাধারী অসংখ্য ঠিকাদারের চেহারাই ভেসে উঠে। তারা সবাই ঠিকাদারী বাণিজ্যের কেউকেটা। ঠিকাদারীর ক্ষেত্রে প্রভাব বলয় সৃষ্টির জন্য তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে ক্ষমতাসীন দল কিংবা সহযোগী সংগঠনে নাম লেখান এবং পদ-পদবী দখল করে নেন। আবার রাজনৈতিক নেতারাও ঠিকাদারী বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠার অসংখ্য নজীর রেখে চলছেন।
নিত্যনতুন কুটকৌশল আর নেটওয়ার্ক মেইনটেন করে নিমিষেই কোটিপতি, শত কোটিপতি হয়ে ওঠার আরেকটি নিশ্চিত পথ হলো ইয়াবা বাণিজ্য। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর ভূমিকায় মাঝে এ ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়লেও তা বন্ধ হয়নি মোটেও। বরং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে মাদক গডফাদাররা ইয়াবার বাণিজ্যের আরো বিস্তৃতি ঘটিয়ে চলছেন। এক সময় প্রশাসনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়িদের থেকে দিন, সপ্তাহ, মাসিক বখড়া আদায়ের বিপরীতে ইয়াবা বেচাকেনার সুযোগ দিতেন। গত কয়েক বছর যাবত প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বখড়ার পরিবর্তে নিজেদের অংশীদারিত্বেই ইয়াবা বাণিজ্য পরিচালনা করছেন মর্মে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ইয়াবা আনা-নেয়া বাণিজ্যে জড়িত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা হাতেনাতে গ্রেফতারও হয়েছেন। সর্বনাশা মাদক ইয়াবা বাণিজ্যে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারাও হঠাৎ কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। এর আগে ইয়াবার কল্যাণে (?) চাল-চুলোহীন পাঁচ শতাধিক লোক শত কোটিপতিতে পরিনত হয়েছেন, আর ক্রোড়পতি হয়ে উঠেছেন অন্তত তিন হাজার ক্ষুদে বিক্রেতা।
তবে কোটিপতি হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে তদবির বাণিজ্য। ধোপদুরস্ত পোশাক পরিচ্ছদ, চলনে বলনে ওভারস্মার্ট- আর সবকিছুর উপরে একটা মুজিবকোর্ট জড়াতে পারলেই সোনায় সোহাগা। সরকারী দল বা সহযোগী সংগঠনে পদ-পদবী থাকুক না থাকুক তাতে কোনো সমস্যা নেই। কখনও একা, কখনও দল বেধে তারা সরকারি দপ্তরে দপ্তরে, শিল্প-কারখানা কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হাজির হয়েই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, নেত্রীর অযাচিত প্রশংসার বিরতিহীন বক্তব্য শুরু করে দেন। দলের জন্য নিজের কল্পিত ত্যাগের বুলি আউড়িয়ে রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি করেন তারা। কোনো জনসভা, মিছিলে অংশ নেয়ার কিংবা নেতার সঙ্গে ছবি তোলা থাকলে তো কথাই নেই। বার বার তা মোবাইল স্ক্রীনে প্রদর্শন করেই তদবিরের আসল বাণিজ্যে নেমে পড়েন এসব ধান্ধাবাজ।
আগে শুধু নিয়োগ, পদোন্নতি, পোস্টিং নিয়ে টুকিটাকি তদবির চালালেও এখন তাদের তদবিরবাজীর ধরন পাল্টেছে, বিস্তৃতিও ঘটেছে। তারা জামায়াত-বিএনপির যেসব নেতা কর্মি মামলায় মামলায় জর্জরিত হয়ে বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন- তাদেরকে সরাসরি ক্ষমতাসীন দল-উপদলে অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এমনকি পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক যোগানের বিনিময়ে তাদের পদ পদবীধারী নেতা বানানোর তদবির বাণিজ্যেও মেতে উঠেছেন তারা। আবার দলের অচেনা অজানা সাধারণ কর্মি সমর্থককে ওয়ার্ড, থানা, জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করা, বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন এনে দেয়ার তদবিরবাজীতেও ব্যস্ত থাকছে চক্রটি। এসব কাজে সফল হোক বা না হোক, লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করে দিব্যি আলীশান জীবন যাপন করে চলে তদবিরবাজরা।
লেখক: সাঈদুর রহমান রিমন।