নিজস্ব প্রতিবেদক
শহরের বাইরের গাড়িগুলোকে রাজধানী শহর ঢাকাকে বাইপাস করে শহর পার করে দেওয়া ও ঢাকার যানজট নিরসনের উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’। প্রকল্পটির প্রথম ধাপ আজ বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন।
আপাতত শাহজালাল আন্তার্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উঠে বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও হয়ে ফার্মগেটে নামছে এই উড়ালপথটি। ফলে দেখা যাচ্ছে উড়ালপথটি শহরের ভেতর থেকে উঠে আবার শহরের ভেতরেই নামছে। এতে রাজধানীবাসী যানজট থেকে কতটা মুক্ত হবেন, সেটা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে।
সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরাও। তবে আশার বাণী শোনাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পসহ (এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা-নামার পথ) মোট দূরত্ব সাড়ে ২২ কিলোমিটার। এই পথে র্যাম্প রয়েছে মোট ১৫টি। এর মধ্যে দুটি র্যাম্পের কাজ শেষ না হওয়ায় আপাতত ১৩টি র্যাম্প নিয়েই রোববার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে ঢাকার বুকের নতুন এ উড়ালপথ।
• খুলছে নতুন দুয়ার, যেসব সুবিধা পাবেন নগরবাসী
বাংলামোটর-কারওয়ান বাজারের সিগন্যালে তো সহজে গাড়ি ছাড়ে না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তখন এই জটের চাপ তো ওপরেও চলে আসবে। নিচের সড়কের গাড়ি যদি চলতে না পারে তবে ওপরের সড়কের গাড়ি নামবে কোথায়?
ঢাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর যানজট নিরসনে এই উড়ালপথটি অনেকটা কার্যকর হবে। উড়ালপথটি ব্যবহার করলে বিমানবন্দর থেকে সর্বোচ্চ ১২ মিনিটে ফার্মগেট পৌঁছাতে পারবে গাড়িগুলো।
কিন্তু ফার্মগেট আসতে বা বিমানবন্দর পৌঁছাতে যেসব র্যাম্প দিয়ে গাড়িগুলো নামবে তার মুখে যদি গাড়ির জট থাকে তবে সেই জট উড়াল সড়কেও উঠে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যদি এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকা শহরকে পুরোপুরি বাইপাস করতে পারতো তাহলে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হতো।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সম্পূর্ণ গন্তব্য বিমানবন্দর থেকে চিটাগং রোড়ের কুতুবখালি পর্যন্ত। প্রকল্পটির প্রথম ধাপে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত উদ্বোধন হচ্ছে আজ। দ্বিতীয় ধাপের কাজ চলামান আছে; যা ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করে চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ।
রাজধানীর বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেছেন, কর্মদিবসগুলোতে উত্তরা থেকে ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার পৌঁছাতে দেড় থেকে আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। রাস্তায় যে পরিমাণ ট্রাফিক থাকে, তাতে গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারও থাকে না। ধরে নিলাম উড়াল সড়ক ব্যবহার করলে রাস্তায় জট হবে না। কিন্তু গাড়িগুলো যেখানে নামবে সেখানকার অবস্থা কী হবে। বাংলামোটর-কারওয়ান বাজারের সিগন্যালে তো সহজে গাড়ি ছাড়ে না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তখন এই জটের চাপ তো ওপরেও চলে আসবে। নিচের সড়কের গাড়ি যদি চলতে না পারে তবে ওপরের সড়কের গাড়ি নামবে কোথায়?
• ২-৩ চাকার বাহন নিষিদ্ধ : বাইকারদের ক্ষোভ
এক্সপ্রেসওয়েটি শহরের ভেতর থেকে উঠে শহরের ভেতরেই নামছে। এক্সপ্রেসওয়ের মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকাকে ভার্টিকালি বাইপাস করা, সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যানজট ওপরেও আসতে পারে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত এক্সপ্রেসওয়ের যুগে আমরা প্রবেশ করলাম। এর আগে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে আমাদের ছিল, কিন্তু সেটি প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত ছিল না। সেই হিসাবে আমাদের এই প্রকল্প যুগান্তকারী প্রকল্প।
তিনি আরও বলেন, কিন্তু এখন এটি যেহেতু আংশিকভাবে চালু হচ্ছে, তাই প্রকল্পের যে মূল লক্ষ্য ছিল সেটি অর্জন সম্ভব হবে না। কারণ, এক্সপ্রেসওয়েটি শহরের ভেতর থেকে উঠে শহরের ভেতরেই নামছে। এক্সপ্রেসওয়ের মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকাকে ভার্টিকালি বাইপাস করা, সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যানজট ওপরেও আসতে পারে। এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যখন কুতুবখালী থেকে বিমানবন্দর হয়ে বাইপাইল পর্যন্ত সংযোগ করা যাবে, তখন এটি ট্রান্সফরমেশন অবকাঠামো হিসেবে কাজ করবে। তখন ঢাকার মধ্যে প্রবেশ না করে এই ভারী যানবাহনগুলো ২৪ ঘণ্টা ঢাকা ক্রস করতে পারবে। যখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে এই যানবাহনগুলো ঢাকাকে ভার্টিকালি বাইপাস করবে তখন নিচের রাস্তাগুলো অনেকটা হালকা হয়ে যাবে। ফলে গণপরিবহনের জন্য প্রসারিত এবং যানজট মুক্ত একটি সড়ক আমরা পাব। তবে এটার জন্য আমাদের ২০২৬-২৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ জানান, এই এক্সপ্রেসওয়ের উদ্দেশ্য ছিল শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গাড়িগুলো যানজট ছাড়া পার করে দেওয়া। এক্সপ্রেসওয়ের একটা চরিত্র আছে। যেখানে গাড়িগুলো বাধাহীনভাবে চলে যেতে পারবে। তবে এখানে দেখা গেছে অনেক জায়গায় র্যাম্প নামানো হয়েছে। এতে করে হয়তো বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়বে। তবে শহরের মধ্যে যেসব জায়গায় র্যাম্প থাকবে, সেখানে ট্রাফিক পদ্ধতি ঠিক না করা গেলে যানজট বাড়বে।
এই পরিকল্পনাবিদ আরও জানান, আংশিক উদ্বোধনের ফলে এটার মূল যে উদ্দেশ্য সেটা ব্যাহত হবে। যে উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছিল সেটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সাময়িক খুলে দেওয়ার সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই থাকবে।
• শেষ হইয়াও হইল না শেষ!
টেকসই ও পিক আওয়ারে সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। এই এক্সপ্রেসওয়ের বেশি সুবিধা পাবে ব্যক্তিগত যান। ২০১৩ সালে যখন এটা হওয়ার কথা ছিল, তখকার প্রেক্ষাপট এক রকম ছিল। আর এখন সেটা ভিন্ন রকম হয়েছে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০০৯ সালে। ২০১১ সালে এটি নির্মাণ চুক্তি সই হয়। কথা ছিল ২০১৩ সালের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়েটি উদ্বোধন করা হবে। তবে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ১০ বছর পর আংশিক উদ্বোধন করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক জানিয়েছেন, এখনকার বাস্তবতায় এই এক্সপ্রেসওয়ে দৃশ্যমান, টেকসই ও পিক আওয়ারে সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। এই এক্সপ্রেসওয়ের বেশি সুবিধা পাবে ব্যক্তিগত যান। ২০১৩ সালে যখন এটা হওয়ার কথা ছিল, তখকার প্রেক্ষাপট এক রকম ছিল। আর এখন সেটা ভিন্ন রকম হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার জানিয়েছেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নতুন পথ তৈরি করেছে। নিচের পথের অর্ধেক গাড়িও যদি ওপরে চলে আসে, তাহলে নিচের পথ তো অনেকটা খালি হবে। এতে করে ট্রাফিক জ্যাম কিছুটা হলেও কমবে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পুরো বেনিফিট পাবে সবাই।