• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১২ অপরাহ্ন

স্মার্ট সুদহার ও মুদ্রাস্ফীতির প্রতিযোগিতায় বিপাকে ব্যবসায়ীরা

অনলাইন ভার্সন
অনলাইন ভার্সন
আপডেটঃ : বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সুদহার নির্ধারণে বর্তমানে একটি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর নাম ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট পদ্ধতি’।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মহামারী ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গত বছর এই ‘স্মার্ট সুদহার’ ব্যবস্থা চালু করা হয়। এরপর থেকে প্রতি মাসেই এই সুদ হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই ‘স্মার্ট’ সুদহারের ফলে প্রায় প্রতি মাসেই বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদ। এতে বিপাকে পড়ছেন ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাসহ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা।

ব্যবসায়ীদের মতে, ক্রমাগত ঋণের সুদহার বৃদ্ধির ফলে বিরাজমান কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে ব্যবসায় যোগ হয়েছে নতুন দুর্দশা।
এরই মধ্যে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩.৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এই অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ছিল ৬.০১ শতাংশ।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর ফর্মুলা বেছে নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যা তাদের জন্য ভালো ফল দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকও গত বছরের জুলাইয়ে একটি মুদ্রানীতির মাধ্যমে নতুন এই সুদহার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়, যা ওই বছরের অক্টোবরে কার্যকর হয়।

অনেক ব্যবসায়ী নতুন এই সুদহারকে অত্যধিক বলে মনে করছেন। ভবিষ্যতে এই সুদহার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে অনিশ্চিতায় ভুগছেন। ফলে নতুন উদ্যোগ বা ব্যবসার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছেন তারা।

অন্যদিকে, ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে সুদের হার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় বাড়ানো হচ্ছে। এতে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা জিডিপিতে প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, যদি আমানতের হার ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ এবং ঋণের সুদের হার ১২ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ হয় তাহলে এখানে পার্থক্য দাঁড়ায় ৬ শতাংশ। এটি ব্যাংকিং খাতের অদক্ষতার কারণে হয়েছে। এ ধরনের ব্যয় কমাতে হবে।

ডিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে ইতোমধ্যে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ব্যবসার খরচ এবং শ্রমিক ব্যয়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক ঋণের ক্রমবর্ধমান সুদের হার ব্যবসাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

তিনি বলেন, “আমরা ব্যবসা শুরু করার সময় ঋণ নিয়েছিলাম ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ সুদে, কিন্তু এখন আমাকে সেই ঋণের সুদ দিতে হবে ১৪ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হারে। কোথায় পাব এই বাড়তি টাকা?

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণা ঋণ পেতে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে।

ডিসিসিআইয়ের এই সাবেক সভাপতি আরও বলেন, “কোন ব্যাংকের সাথে একীভূতকরণ কখন হবে তা কেউ আগে থেকে জানতে পারে না। ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তাই সবাই এখন নতুন ঋণ নেওয়ার চেয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধে ব্যস্ত।”

পোশাক খাতের উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কিস্তি পরিশোধে বিলম্বের জন্য ২ শতাংশ বা তার বেশি জরিমানা দিতে হবে। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়ার পর, আমরা ১৩ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছি। কেন এটা দিতে হবে? এতে আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। নতুন জনবল নিয়োগ করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।”

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ‘স্মার্ট রেট’ বাস্তবায়ন করেছে। এই মুহূর্তে এর কোনও বিকল্প নেই। তবে স্মার্ট রেট বাস্তবায়নের পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

সুদের হার বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিলে ব্যাংকিং খাতে ঋণের হার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। মার্চে এটি ছিল ১৩.১১ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ১২.৪৩ শতাংশ, জানুয়ারিতে ১১.৮৯ শতাংশ এবং গত বছরের ডিসেম্বরে ১১.৪৭ শতাংশ ও নভেম্বরে ছিল ১০.৯৩ শতাংশ।

২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে যখন মহামারী এবং বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের সূত্রপাতের কারণে দেশের অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়ে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন এই স্মার্ট সুদহার প্রবর্তন করে।

প্রতি মাসের শেষে বা মাসের প্রথম দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্মার্ট সুদের হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক, যা পরবর্তী মাসে বিতরণ করা নতুন ঋণের জন্য প্রযোজ্য হয়। অর্থাৎ ডিসেম্বরে ঘোষিত স্মার্ট সুদহার জানুয়ারি মাসের জন্য প্রযোজ্য হয়। তবে প্রতি মাসে গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার পরিবর্তন করা হয় না। একজন গ্রাহক যে মাস থেকে ঋণ নেন তখনকার প্রচলিত সুদের হার পরবর্তী ছয় মাসের জন্য কার্যকর হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে- ২০২৩ সালের জুলাই ও আগস্ট- ঋণের সুদের হার ছিল যথাক্রমে ৭.১০ শতাংশ এবং ৭.১৪ শতাংশ।

এরপর সেই বছরের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে সুদহার বাড়িয়ে যথাক্রমে ৭.২০ শতাংশ ও ৭. ৪৩ শতাংশ করা হয়। নভেম্বর এবং ডিসেম্বর ২০২৩-এ এটি বাড়িয়ে যথাক্রমে ৭.৭২ শতাংশ এবং ৮.১৪ শতাংশ করা হয়।

চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে বেঞ্চমার্ক সুদের হার ছিল ৮.৬৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা ছিল ৯.৬১ শতাংশ এবং মার্চে তা লাফিয়ে ১০.৫৫ শতাংশ হয়েছে।

ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণের সুদ নির্ধারণের জন্য স্মার্ট হারের সঙ্গে আরও ৩ শতাংশ যোগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আগে ব্যাংকগুলোকে বেঞ্চমার্ক হারের সঙ্গে ৩.৫০ শতাংশ যোগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.১ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তবে আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে ৬.৬ শতাংশ হতে পারে বলে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এডিবির এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) এপ্রিল ২০২৪ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ