১০:৫৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

সিলেটবাসীর আতঙ্ক যুবদল নেতা আবুল কাশেম অবশেষে কারাগারে

ডেস্ক নিউজ

ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে সিলেটজুড়ে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিলেন সিলেট জেলা যুবদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম। রাজনীতির ছত্রছায়ায় গড়ে তোলা তার অপরাধ সাম্রাজ্যে রয়েছে চোরাচালান, চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, অবৈধ বালু উত্তোলন, অপহরণসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।

সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট দিয়ে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণকারী হোতা হিসেবে পরিচিত কাশেম বিপুল পরিমাণ কালো টাকায় গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। স্থানীয়দের অভিযোগ—দিন দিন এলাকায় তিনি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।

গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের নলজুড়ী গ্রামের মৃত সামসুল হকের ছেলে আবুল কাশেম বিএনপি নেতা হলেও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অর্থদাতা হিসেবেও পরিচিত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার অন্যতম সংগঠক হিসেবেও তার নাম উঠে এসেছে।

ঢাকার সিএমএম আদালতে কাশেমের বিরুদ্ধে রয়েছে সিআর মামলা নং ৬৩/২০২৫ ও ১১৮/২০২৫ এবং বাড্ডা থানায় মামলা নং- ৬/২৫ ।

এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়ের করা এক মামলায় বলা হয়, কাশেম সরকার ঘোষিত “পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা” জাফলং-ডাউকি ও পিয়াইন নদীর আশপাশ থেকে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করে আসছেন, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা ৫ লঙ্ঘন এবং একই আইনের ১৫(১) ধারার টেবিলের ২ নম্বর ক্রমিক অনুযায়ী এই অপরাধের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গোয়াইনঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয় (এফআইআর নং: ৩৫/৯০, তারিখ: ২৫/০৩/২০২৫)।

এই মামলার পর কাশেম পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালকের ওপর হত্যার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অবশেষে দীর্ঘ অভিযোগ, প্রতিবাদ ও আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে আদালতের নির্দেশে আবুল কাশেমকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এতে করে এলাকাবাসী কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

কাশেমের বিরুদ্ধে আরও রয়েছে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ। ব্যবসায়ী সুফিয়ান আহমদের দাবি—গত ১ নভেম্বর সারিঘাট এলাকায় তার কাছ থেকে কাশেম ও তার সহযোগীরা ২৫ লাখ টাকার একটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় ১১ নভেম্বর তিনি সিলেট সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘দ্রুত বিচার আইনে’ মামলা দায়ের করেন।

কাশেমের ডানহাত হিসেবে পরিচিত শাহেদ আহমেদ লিটন ওরফে বাবলা—দু’জন মিলে গোয়াইনঘাটে মাদক ও চোরাচালানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

এছাড়া, গত ৫ আগস্ট কাশেমের নেতৃত্বে গোপাল শর্মার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়, যা নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং: ৪৩৪) হয়েছে।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা কাশেমকে একাধিকবার সতর্ক করলেও তিনি কোনো কথায় কর্ণপাত করেননি। বরং অবৈধ অর্থবলের জোরে দলের ভেতরেও ভয়ভীতি ছড়িয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তিনি বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করিয়ে এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারদের ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন করেছেন।

গত ৬ নভেম্বর বিজিবি-৪৮ ব্যাটালিয়নের অভিযানে রাধানগর এলাকা থেকে ৮ কোটি টাকার ভারতীয় চোরাই পণ্যের চালান জব্দ হয়, যার পেছনে কাশেম ও শান্তিনগরের জয়দুল হোসেনের নাম উঠে আসে। ২৪ অক্টোবর ভারতীয় চিনি পাচারের সময় আটক ট্রাকের মালিকও ছিলেন কাশেম।

নিজ দলের নেতারাও তার প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিনকে অপহরণ করে তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন ও সাধারণ জনগণ মানববন্ধন করেছে।

স্থানীয় প্রবীণ ও সাবেক ইউপি সদস্য আবুল হাসিম সুন্দই বলেন, “এত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এর আগে এ এলাকায় দেখা যায়নি। আবুল কাশেমের কর্মকাণ্ড ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “কাশেমের চক্র তামাবিল স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চাঁদা আদায় করছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে।”

সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া না থাকলে বহু আগেই আইনের আওতায় আসতেন কাশেম। তবে এবার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় সিলেটজুড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন সাধারণ মানুষ।

Please Share This Post in Your Social Media

আপডেট: ১১:৫১:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
১৯৩

সিলেটবাসীর আতঙ্ক যুবদল নেতা আবুল কাশেম অবশেষে কারাগারে

আপডেট: ১১:৫১:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে সিলেটজুড়ে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিলেন সিলেট জেলা যুবদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম। রাজনীতির ছত্রছায়ায় গড়ে তোলা তার অপরাধ সাম্রাজ্যে রয়েছে চোরাচালান, চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, অবৈধ বালু উত্তোলন, অপহরণসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।

সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট দিয়ে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণকারী হোতা হিসেবে পরিচিত কাশেম বিপুল পরিমাণ কালো টাকায় গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। স্থানীয়দের অভিযোগ—দিন দিন এলাকায় তিনি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।

গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের নলজুড়ী গ্রামের মৃত সামসুল হকের ছেলে আবুল কাশেম বিএনপি নেতা হলেও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অর্থদাতা হিসেবেও পরিচিত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার অন্যতম সংগঠক হিসেবেও তার নাম উঠে এসেছে।

ঢাকার সিএমএম আদালতে কাশেমের বিরুদ্ধে রয়েছে সিআর মামলা নং ৬৩/২০২৫ ও ১১৮/২০২৫ এবং বাড্ডা থানায় মামলা নং- ৬/২৫ ।

এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়ের করা এক মামলায় বলা হয়, কাশেম সরকার ঘোষিত “পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা” জাফলং-ডাউকি ও পিয়াইন নদীর আশপাশ থেকে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করে আসছেন, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা ৫ লঙ্ঘন এবং একই আইনের ১৫(১) ধারার টেবিলের ২ নম্বর ক্রমিক অনুযায়ী এই অপরাধের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গোয়াইনঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয় (এফআইআর নং: ৩৫/৯০, তারিখ: ২৫/০৩/২০২৫)।

এই মামলার পর কাশেম পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালকের ওপর হত্যার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অবশেষে দীর্ঘ অভিযোগ, প্রতিবাদ ও আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে আদালতের নির্দেশে আবুল কাশেমকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এতে করে এলাকাবাসী কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

কাশেমের বিরুদ্ধে আরও রয়েছে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ। ব্যবসায়ী সুফিয়ান আহমদের দাবি—গত ১ নভেম্বর সারিঘাট এলাকায় তার কাছ থেকে কাশেম ও তার সহযোগীরা ২৫ লাখ টাকার একটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় ১১ নভেম্বর তিনি সিলেট সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘দ্রুত বিচার আইনে’ মামলা দায়ের করেন।

কাশেমের ডানহাত হিসেবে পরিচিত শাহেদ আহমেদ লিটন ওরফে বাবলা—দু’জন মিলে গোয়াইনঘাটে মাদক ও চোরাচালানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

এছাড়া, গত ৫ আগস্ট কাশেমের নেতৃত্বে গোপাল শর্মার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়, যা নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং: ৪৩৪) হয়েছে।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা কাশেমকে একাধিকবার সতর্ক করলেও তিনি কোনো কথায় কর্ণপাত করেননি। বরং অবৈধ অর্থবলের জোরে দলের ভেতরেও ভয়ভীতি ছড়িয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তিনি বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করিয়ে এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারদের ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন করেছেন।

গত ৬ নভেম্বর বিজিবি-৪৮ ব্যাটালিয়নের অভিযানে রাধানগর এলাকা থেকে ৮ কোটি টাকার ভারতীয় চোরাই পণ্যের চালান জব্দ হয়, যার পেছনে কাশেম ও শান্তিনগরের জয়দুল হোসেনের নাম উঠে আসে। ২৪ অক্টোবর ভারতীয় চিনি পাচারের সময় আটক ট্রাকের মালিকও ছিলেন কাশেম।

নিজ দলের নেতারাও তার প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিনকে অপহরণ করে তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন ও সাধারণ জনগণ মানববন্ধন করেছে।

স্থানীয় প্রবীণ ও সাবেক ইউপি সদস্য আবুল হাসিম সুন্দই বলেন, “এত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এর আগে এ এলাকায় দেখা যায়নি। আবুল কাশেমের কর্মকাণ্ড ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “কাশেমের চক্র তামাবিল স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চাঁদা আদায় করছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে।”

সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া না থাকলে বহু আগেই আইনের আওতায় আসতেন কাশেম। তবে এবার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় সিলেটজুড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন সাধারণ মানুষ।